কখনও মমতার মঞ্চে, কখনও চাকরিহারা শিক্ষকদের হুমকি, নেত্রীর ‘অবমাননায়’ আদালতে মামলা! কেন ‘সক্রিয়’ সব্যসাচী?
আনন্দবাজার | ২০ মে ২০২৫
ঘটনা ১: মুর্শিদাবাদের হিংসায় নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে চলতি মাসের গোড়ায় সুতিতে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঞ্চে হাজির সব্যসাচী দত্ত।
ঘটনা ২: সল্টলেকে বিকাশ ভবনের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে এক তৃণমূল নেতা হুঙ্কার দিয়েছিলেন, ‘‘এটা আমার ওয়ার্ড। ফাঁকা করতে ৩০ সেকেন্ড লাগবে না!’’ নেতার নাম সব্যসাচী দত্ত।
ঘটনা ৩: দিঘার মন্দির উদ্বোধন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতার উদ্দেশে ‘অবমাননাকর’ মন্তব্য করেছেন বলে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সন্ন্যাসী কার্তিক মহারাজের বিরুদ্ধে কলকাতা হাই কোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেছেন তৃণমূলের এক নেতা। সব্যসাচী দত্ত।
রাজারহাট-নিউ টাউনের প্রাক্তন বিধায়ক সব্যসাচী এত ‘সক্রিয়’ কেন? বিধাননগর এবং রাজারহাট-নিউ টাউনের স্থানীয় স্তরের তৃণমূলে খোঁজ নিলে জানা যাচ্ছে, এই ‘সক্রিয়তা’ গত কয়েক মাস ধরেই। সেই মহলের আরও বক্তব্য, বিধানসভা ভোট যত এগিয়ে আসবে, সব্যসাচীর সক্রিয়তা তত বাড়বে। কারণ, ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে সব্যসাচী আবার তাঁর পুরনো আসন রাজারহাট-নিউ টাউনের বিধায়ক হতে চান। ভোটে জিতে-টিতে গেলে মন্ত্রী হওয়ার আশাও যে রাখেন না, তা-ও নয়। প্রসঙ্গত, বিজেপি থেকে সব্যসাচীকে তৃণমূলে ফিরিয়ে আনার নেপথ্যে বড় ভূমিকা ছিল দলের সর্বময় নেত্রী মমতার। তাই তাঁর আশপাশে সব্যসাচীকে দেখে টিকিট-জল্পনা আরও বেড়েছে।
ঘটনাচক্রে, কয়েক মাস হল সব্যসাচী বাড়ি বদলেছেন। বিধাননগরের বদলে তিনি এখন থাকছেন নিউ টাউনের রায়গাছির একটি আবাসনে। ভোটে দাঁড়াতে গেলে সেই কেন্দ্রের সঙ্গে নৈকট্য বৃদ্ধি প্রয়োজন। প্রার্থী হওয়ার জন্যই কি তাঁর এই ‘নড়াচড়া’? সব্যসাচী ‘হ্যাঁ’ বলেননি। তেমনই ‘না’-ও বলেননি। বলেছেন, ‘‘আমি এ বিষয়ে কোনও কথা বলব না। কারণ, প্রার্থী হওয়া বা না-হওয়ার সিদ্ধান্ত দল এবং দলনেত্রীর উপর নির্ভর করে।’’
সব্যসাচী ছিলেন একাধারে বিধাননগরের মেয়র এবং রাজারহাট-নিউ টাউনের বিধায়ক। কিন্তু ২০১৯ সালের অক্টোবরে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে অমিত শাহের হাত ধরে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। বিজেপি সূত্রের দাবি, সব্যসাচীর পদ্মশিবিরে যোগদানের অন্যতম ‘শর্ত’ ছিল, তাঁকে সুজিতের বিরুদ্ধে বিধাননগর আসনে প্রার্থী করতে হবে। সেই শর্ত মেনেই ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে বিধাননগরে সব্যসাচীকেই প্রার্থী করে বিজেপি। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকলেও (সম্ভবত সেই অঙ্ক কষেই সব্যসাচীর বিজেপি-তে গমন) বিধানসভায় সুজিতের কাছে প্রায় ৮,০০০ ভোটে হারেন তিনি। দেরি না করে সেই বছরের অক্টোবরে বিধানসভায় গিয়ে তৃণমূলের তৎকালীন মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের হাত থেকে জোড়াফুলের পতাকা নিয়ে তৃণমূল-ওয়াপসি হয় সব্যসাচীর। তার পরে বিধাননগর পুরনিগমের ভোটে তৃণমূল তাঁকে প্রার্থী করে। তিনি জিতে চেয়ারম্যান হন। যদিও মেয়র আর হওয়া হয়নি তাঁর। পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের ‘আস্থাভাজন’ হলেও।
অনেকের আবার বক্তব্য, বিধাননগরের মেয়র পদ ফিরে পাওয়ার বাসনাও থাকতে পারে সব্যসাচীর। তবে এখনও পর্যন্ত বিধাননগরের মেয়র হিসাবে মমতা আস্থা রেখেছেন কৃষ্ণা চক্রবর্তীর উপরেই। এখনও পর্যন্ত যা সমীকরণ, তাতে কৃষ্ণা নিজে অনিচ্ছুক না হলে পরের পুরভোটেও সম্ভবত তাঁকে সামনে রেখেই বিধাননগরের নির্বাচনে বিরোধীদের মোকাবিলায় নামবে তৃণমূল। কিন্তু সব্যসাচী আবার নিছক কাউন্সিলর এবং নাম-কা-ওয়াস্তে চেয়ারম্যান হয়ে সন্তুষ্ট থাকার লোক নন। বিশেষত, তিনি যখন আগে এক বার বিধায়ক হয়ে গিয়েছেন। ফলে মেয়র না হলে অন্তত বিধায়ক হতে চান তিনি।
কিন্তু বাস্তব বলছে, রাজারহাট-নিউ টাউন আর সব্যসাচীর ‘খাসতালুক’ নেই। ২০২১ সালে সব্যসাচীর ছেড়ে যাওয়া ওই আসনে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছিলেন সিপিএম ছেড়ে আসা তাপস চট্টোপাধ্যায়। প্রায় ৫৬ হাজার ভোটে বিজেপি প্রার্থীকে হারিয়ে প্রথম বারের জন্য বিধায়ক হন তিনি। কেউ আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকার না করলেও তৃণমূলে কথিত যে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগ্রহে তাপস তৃণমূলে এসেছিলেন। ফলে সব্যসাচীর পথে কাঁটা রয়েছে।
একটা সময়ে বিধাননগরে যেমন সুজিত-অনুগামীদের সঙ্গে সব্যসাচী-অনুগামীদের সংঘাত চলত, ইদানীং তেমনই দেখা যাচ্ছে রাজারহাট-নিউ টাউনে। তাপসের লোকলস্করের সঙ্গে সব্যসাচীর গোষ্ঠীর সংঘর্ষ হচ্ছে। কোথাও কোথাও গোলাগুলি চলার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে ‘যুদ্ধ’ কার্যত বেধে গিয়েছে। অন্য দিকে, বিধায়ক হিসাবে তাপসের ভূমিকা দলের নেতৃত্বের কাছে ‘সন্তোষজনক’ বলে দাবি জেলা তৃণমূলের এক প্রভাবশালী নেতার। সব্যসাচী দল ছেড়ে যাওয়ার পর যে ভাবে ব্যবধান বাড়িয়ে তাপস ওই আসনে জয়ী হয়েছিলেন, তা-ও ক্যামাক স্ট্রিটের নজরে রয়েছে বলে বক্তব্য ওই নেতার।
সব্যসাচী সম্পর্কে তাঁর অনুগামীরা বলেন, ‘‘দাদার মাথা সব দিকে সমান ভাবে চলে।’’ তবে পরিস্থিত যা, তাতে ২০২৬ সালে রাজারহাট-নিউ টাউনের টিকিট পেতে গেলে নিজের নামের মর্যাদা রেখে দু’টি হাতও সমানে সমানে চালাতে হবে সব্যসাচীকে। দুই হাতে সামলাতে হবে দলের দুই স্তম্ভ — মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।