বুদ্ধদেব বেরা, ঝাড়গ্রাম
এক সময়ে যে কোনও জায়গায় যেতে হলেই প্রয়োজন ছিল তাঁদের। শহরের অলি-গলি, পাড়ার মোড়- সব জায়গাতেই তাঁদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত। এক সময়ে বাড়বাড়ন্ত থাকা সেই রিকশাওয়ালারা আজ সর্বত্রই বাড়ন্ত। যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাজার দখল করেছে ব্যাটারি-চালিত টোটো। গতি বেশি, খরচ কম। আর এই অসম লড়াইয়ে হারিয়ে যেতে বসেছেন রিকশাওয়ালারা। কিন্তু পেটের ভাত জোগাতে আজও সেই ত্রিচক্রযানই সম্বল ঝাড়গ্রামের পরিতোষ হাওলাদারের।
২২ বছর বয়সে স্ত্রী উষারানির হাত ধরে পূর্ববঙ্গ থেকে কাঁচরাপাড়ায় চলে এসেছিলেন পরিতোষ। সেখান থেকে সোজা ঝাড়গ্রাম। দৈনিক ৯ টাকা মজুরিতে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ দিয়ে শুরু। কিছু দিন পরে শুরু করেন কাঠমিস্ত্রির কাজ। খুড়তুতো ভাইয়ের রিকশা থাকায় কাজের ফাঁকে তাঁর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে রিকশা চালানো শিখে নেন পরিতোষ।
পরে রিকশা ভাড়া নিয়ে চালাতে শুরু করেন। ২ টাকা, ৩ টাকা, ৫ টাকার বিনিময়ে ভাড়া খেটে রিকশার ভাড়া দিয়েও দিব্যি সংসার চলে যেত তাঁর। পরে ৩৫০০ টাকা দিয়ে নিজের রিকশাও কিনেছিলেন।
পরিতোষের পাড়ায় পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মানুষের বসতি থাকায় বাড়তে থাকে রিকশাওয়ালার সংখ্যা। জুটে যায় বন্ধুও। আজ কেউ বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কেউ পানের দোকান দিয়েছেন। কিন্তু পরিতোষ আজও বুড়ো হাড়ে প্যাডেলে চাপ দেন। প্রতিদিন এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীকে বাজারে নিয়ে যান, বাড়ি ফিরিয়ে আনেন। হাতে আসে ১০০ টাকা।
মাসে এক দিন ব্যাঙ্কে পেনশন তোলার জন্য গেলে বাড়তি পাওনা ৫০ টাকা। পুরোনো ‘সঙ্গীকে’ আজও ঝকঝকে রেখেছেন পরিতোষ। বলেন, ‘জীবনের বহু সুখ-দুঃখের সঙ্গী আমার এই রিকশা। পুরো পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছে। যতদিন বাঁচব, একে আঁকড়েই বাঁচব।’
অন্য দিকে, ঝাড়গ্রামের শক্তিনগরের বাসিন্দা শঙ্কর ধাড়াও রিকশা চালিয়েই সংসারের বোঝা টেনেছেন, মেয়ের বিয়েও দিয়েছেন। ২০১২ সালে ঝাড়গ্রামকে যেন
দু’টুকরো করে দেয় উড়ালপুল। তার জেরে ব্যবসার পরিধি ছোট হচ্ছিলই। টোটো আসার পরে রিকশার চাহিদা মুখ থুবড়ে পড়ে। সাকুল্যে তিনশো টাকায় কেওড়া গোডাউনে কেজি দরে নিজের রিকশা বিক্রি করে দেন শঙ্কর। এখন পরিচারিকার কাজ করে সংসার চালান স্ত্রী শকুন্তলা।
এক সময়ে ঝাড়গ্রাম শহরের জামদা থেকে শুরু করে পুরাতন ঝাড়গ্রাম পর্যন্ত প্রায় ২০টি রিকশা স্ট্যান্ড ছিল। সবচেয়ে বড় রিকশা স্ট্যান্ড ছিল লোকাল বোর্ড, স্টেশনের সামনে পোস্ট অফিস, শিব মন্দির মোড় ও পাঁচ মাথার মোড়ে। ঝাড়গ্রাম শহরের রঘুনাথপুরের বাসিন্দা সত্যব্রত সৎপথীর বক্তব্য, ‘বাড়ির বাইরে কোথাও কাজে যাওয়ার কথা ভাবলে রিকশা ডাকতে হতো। এখন টোটো ডেকে নিই। কিন্তু রোজ সকালে একটা রিকশা যাতায়াত করতে দেখি।’
শুধু রিকশাওয়ালারাই নন, হারিয়ে গিয়েছে রিকশা ভাড়া দেওয়ার সংস্থাও। ঝাড়গ্রামের সবচেয়ে বড় রিকশা ভাড়ার সংস্থা ছিল বিশ্বাস কোম্পানি। ১০ টাকার বিনিময়ে ভাড়া দেওয়া হতো ৫০০টির বেশি রিকশা, হতো সারাইয়ের কাজও। আজ তা হারিয়ে গিয়েছে।
দুই মালিক তপন ও তাপস বিশ্বাসের মধ্যে বড় ভাই তপন এখন কলকাতায় থাকেন। তাপস অবশ্য ঝাড়গ্রামে। তিনি বলেন, ‘প্রতি মাসে পাঁচ থেকে দশটি নতুন রিকশা কেনা হতো। টোটো আসার পরে সব শেষ হয়ে গেল। এখন ওভেন, পাখা সারিয়ে দিন গুজরান করি।’