আশিস করণ,ঘাটাল
পুলক বেরা, তমলুক
'দাদা, একটু ছায়া পাই কোথায় বলতে পারেন।'
নাহ, 'অবাক জলপান' নাটকের সেই পথিক এ কথা বলেননি। কিন্তু ঘাটাল কিংবা তমলুকের পথিকরা কিন্তু হামেশাই এমন প্রশ্ন করছেন। চৈত্রের শুরু থেকেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রোদের তেজ। বইছে লু। তার মধ্যেও মানুষকে কাজে বেরোতেই হয়। একবেলা বাজারে ফল নিয়ে না-বসলে সে দিনের রুটি জুটবে না অনেকেরই। ব্যাঙ্কের কাজ হোক বা আদালতের কোনও কাজ, সবকিছুর জন্যই বাইরে বেরোতেই হয়। কিন্তু এই গনগনে রোদে রাস্তায় ছায়ার দেখা মেলা ভার। ছায়া কি তবে ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেল। ছায়া-সন্ধান করতেই এক বেরসিক ছুড়ে দিলেন টিপ্পনী, 'ছায়াও লাগবে, গাছ কাটাও চলবে-এ দুটো তো একসঙ্গে চলতে পারে না।'
ঘাটিনল থেকে তমলুক দৃশ্যটা কমবেশি একই। গাছের দেখা নেই। আর তাই ছায়াও উধাও। জরুরি কাজে রাস্তায় বেরোলে একটু ছায়ার খোঁজে হন্যে হচ্ছেন মানুষ। কোথাও কোনও ছায়ার দেখা পেলে, পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার মতো খুশি হচ্ছেন লোকজন। শুক্রবার নয়, যে কোনও বারের হাটে আসা ব্যবসায়ীদের অবস্থাও তথৈবচ। বিকিকিনির সময়ে চড়া রোদে ভরসা কেবল ছাতা।
কিন্তু সেই ছত্রচ্ছায়ায় কি আর শান্তি মেলে। অগত্যা তাই-ই ভরসা। দাসপুর থানার অন্যতম হাট জয়কৃষ্ণপুর। এই হাটে দীর্ঘদিনের বিক্রেতা অনুপ ভূঁইয়া বলেন, 'এক সময়ে ভরদুপুরেও গোটা হাটটাই ছায়াময় থাকত। গ্রীষ্মের এমন কিছু সময় কেটেছে, যখন হাটের জিনিসপত্র বিক্রি করে এখানেই গাছের তলায় দুপুরে দু'মুঠো মুড়ি আর জল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। বিকেলে রোদ পড়লে বাড়ির দিকে রওনা দিতাম। এখন একটা বা দুটো গাছই ভরসা।'
অন্য দিকে, বহু জায়গাতেই এখনও যাত্রী প্রতীক্ষালয় নেই, রাস্তা সম্প্রসারণের সময়ে ভাঙা পড়ার পরে আর তৈরি হয়নি। সম্প্রসারণের জেরেও কাটা পড়েছে গাছ। ঘাটাল পাঁশকুড়া রাজ্য সড়কের উপরে সুলতাননগর বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষারত এক যাত্রীর বক্তব্য, 'আগে কত গাছ ছিল। তার ছায়াতেই বাসের জন্য অপেক্ষা করতাম। রাস্তা বাড়ার সময়ে গাছও কাটা পড়েছে। এখন একটাই গাছ আছে। তাতে আর কতটুকুই বা স্বস্তি মেলে।'
তমলুকের আদালত চত্বরে রোজ নানা কাজে ভিড় জমান হাজারও মানুষ। গ্রীষ্মের দুপুরে গরম থেকে কিছুটা স্বস্তি দেয় স্থানীয় এক শিরীষ গাছ। তার ছায়াতেই মেলে সাময়িক স্বস্তি। আদালতে আসা শোভন চক্রবর্তী বলেন, 'আধুনিক যুগেও গাছের তলায় বসে প্রকৃতির হাওয়া যেন এক আলাদা অনুভূতি দেয়। দেদার গাছ কেটে তৈরি হয়েছে বহুতল। বসেছে এসি, কুলার। কিন্তু তীব্র গরমের সময়ে গোদের উপরে বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিদ্যুৎ সঙ্কট। এখন ছায়া না-থাকায় ছায়ার মর্যাদা বুঝছেন অনেকেই।
সে বিষয়ে কথ্য বলতে গিয়ে গোমকপতা উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সুব্রত বুড়াইয়ের গলায় স্পষ্ট আক্ষেপের সুর, 'আগে স্কুল থেকে ফিরে গাছের ছায়ায় বসে আড্ডা দিতাম। আজকাল সভ্যতার ঠেলায় সেই ছায়া অমিল। এক চিলতে গাছের ছায়া পেতে এখন বন-বনান্তরে ছুটে যেতে হয়।'
তবে, ছায়ার পরিমাণ বাড়ানোর জন্য উদ্যোগীও হচ্ছেন অনেকে। তমলুকের বৃক্ষপ্রেমী বীতশোক পট্টনায়েক বলছেন, 'বৃক্ষরোপণ নিয়ে আমরা সারা বছর প্রচার চালাই। বর্তমানের জন্য না-হলেও, অন্তত ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমাদের সবুজ বাড়ানো উচিত। এই উদ্যোগে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।' বীতশোক আশাবাদী, এ উদ্যোগ শুধু 'ছায়ার পিছনে ছোটা' হয়ে থেকে যাবে না। প্রবল গরমের হাত থেকে রক্ষা পেতে মানুষ আক্ষরিক অর্থেই ছায়ার পিছনে ছুটবেন।