সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: এ যেন সিনেমার প্লট! দুষ্কৃতীদের ডেরায় ডেরায় গিয়ে অপহৃতকে উদ্ধার করতে হানা দিচ্ছে পুলিশ। আর অপহরণকারীরা অপহৃত ব্যবসায়ীকে ছাড়তে নারাজ। তাদের লক্ষ্য যে মুক্তিপণ! কিন্তু পুলিশের একাধিক দল ঝাড়খণ্ডের ওই দুষ্কৃতীদের একের পর এক গোপন ডেরায় গিয়ে হানা দেওয়ায় শেষমেষ নিজেদের গ্যাংকে বাঁচাতে অপহৃতকে ফেলে রেখেই পালিয়ে গেল অপহরণকারীরা। ফলে অপহরণের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই পুরুলিয়ার ঝালদার ব্রজপুরের কয়লা ব্যবসায়ী লোকেশ গরাঁইকে উদ্ধার করার চ্যালেঞ্জ জিতে নিল পুরুলিয়া জেলা পুলিশ। যে কাজ খুব একটা সহজ ছিল না।
ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ এলাকার টুন্ডি থানার পেট্রল পাম্পের কাছ থেকে মঙ্গলবার রাতে উদ্ধার হন ওই ব্যবসায়ী। ওইদিনই ধানবাদ এলাকার ভুলি আউটপোস্ট থেকে উদ্ধার হয় সেই চার চাকার কালো গাড়ি। যে গাড়িতে করে ঝাড়খণ্ডের দুষ্কৃতীরা ওই ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে। গত ১৯ মে ভোর ৫ টা ৪৫ মিনিট নাগাদ ব্রজপুরের ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া সাধুডেরার কাছ থেকে লোকেশ গরাঁই নামে ওই ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে ঝাড়খণ্ডের গ্যাং। ব্যবসার লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়েই এই অপহরণ বলে প্রাথমিক তদন্তে মনে করছে পুলিশ।
পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সোমবার ভোরে অপহরণের পর প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান থেকে যে কটি সূত্র মিলেছিল তার হাত ধরেই ব্যবসায়ীর হদিশ মেলে। পুলিশের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিলো অক্ষত অবস্থায় ব্যবসায়ীকে উদ্ধার করা। সেই কাজ করা গিয়েছে। ঝাড়খণ্ড পুলিশ পুরুলিয়া পুলিশকে সাহায্য করেছে। এই ঘটনায় যারা জড়িত তাদেরকে চিহ্নিত করা গিয়েছে। তাদেরকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে।” যে এলাকা থেকে অপহৃত ব্যবসায়ী উদ্ধার হয় সেখানেই রয়েছে অপরাধ জগতের ‘গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর’-র ডেরা। এই কাজ ওই গ্যাংয়ের কিনা সেইসব কিছু খতিয়ে দেখছে পুলিশ। এই গ্যাং কতটা দুর্ধর্ষ তা মালুম হয় ওয়েব সিরিজে। অপহরণের পর কাউকে এখানে নিয়ে আসা হলে তাকে আর ফেরানো যায় না। যেখানে কার্যত ঢুকতে পারে না পুলিশও।
সেখানেই মিলল পুরুলিয়া জেলা পুলিশের এই সাফল্য। ওই অপহৃত ব্যবসায়ীকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করতে পুরুলিয়া ও ধানবাদ জেলা পুলিশ যেভাবে সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছিল তাতে অপহরণকারীরা বাধ্য হয় ওই টুন্ডি পেট্রোল পাম্পের কাছে ওই ব্যবসায়ীকে ছেড়ে দিতে। ওই ব্যবসায়ীপুলিশকে জানিয়েছে, দুষ্কৃতীরা মুক্তিপণ দাবি করত। তবে মুক্তিপণ চেয়ে ওই ব্যবসায়ীর পরিবারের কাছে কোন ফোন আসেনি। এই ঘটনার তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অভিযান) যোধাবর অবিনাশ ভীমরাও। তাঁর এই অপারেশনের বিভিন্ন টিমে ছিল ঝালদা মহকুমা পুলিশ আধিকারিক গৌরব ঘোষ সহ জয়পুর, সাঁওতালডি, ঝালদা, পাড়া, থানা, বাগলতা তদন্ত কেন্দ্র ও স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ।
প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে অপহরণ হয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। সেইসময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন ওই গ্রামের বাসিন্দা ভৃগুরাম চালক। ওই দিন ভোরে অপহরণকারীরা তাকে লাঠিপেটা করে সরিয়ে ওই ব্যবসায়ীর মুখে গামছা বেঁধে টেনে গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে চলে যায় বলে অভিযোগ। ওইদিন বিকালে ওই ব্যবসায়ীর স্ত্রী ললিতা গরাঁই ঝালদা থানায় অপহরনের অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে অজ্ঞাত পরিচয় দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা হয়। পুলিশ বিভিন্ন খোঁজখবর করে জানতে পারেন, ওই কয়লা ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে দুষ্কৃতীরা ঝাড়খণ্ডে গা ঢাকা দিয়েছে। তারা সকলেই ঝাড়খণ্ডের।
ওই এলাকার বেশ কয়েকটি থানার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে ঝাড়খণ্ড পুলিশের সহায়তায় তদন্ত শুরু করে পুরুলিয়া জেলা পুলিশ। ওই কয়লা ব্যবসায়ী লোকেশ গরাঁই-র বাড়ি ঝাড়খন্ড সীমানা ছুঁয়ে থাকা ব্রজপুরে। দীর্ঘদিন ধরেই কয়লার ব্যবসায়ীর সঙ্গে যুক্ত তিনি। পুরুলিয়া জেলা পুলিশের এই সাফল্যে খুশি ওই ব্যবসায়ীর পরিবার। তার দাদা দীনেশ গরাঁই বলেন, ” বাড়ির সবাই খুব দুশ্চিন্তায় ছিল। পুলিশ যেভাবে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছে তাতে আমরা খুশি।”