টাকার ভাগ নিয়ে লড়াইয়ের জের বোর্ড বাতিল হয়েছে রঘুনাথপুরে
বর্তমান | ২২ মে ২০২৫
নিজস্ব প্রতিনিধি, পুরুলিয়া ও সংবাদদাতা, রঘুনাথপুর: গত মার্চেই ‘অম্রুত’ প্রকল্পে ভালো কাজ কাজ করার সুবাদে পুরস্কৃত হয়েছিল রাজ্যের ১১টি পুরসভা। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর পুরসভার ভাগ্যে অবশ্য কোনও পুরস্কার জোটেনি। উল্টে, ‘অম্রুত’ প্রকল্পই জলে ডোবাল রঘুনাথপুর পুরসভার নির্বাচিত বোর্ডকে!
পুরসভা সূত্রের খবর, রঘুনাথপুর শহরে বাড়ি বাড়ি নলবাহিত পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে দিতে ‘অম্রুত’ প্রকল্পের বরাদ্দ হয়েছিল প্রায় ৮৪কোটি টাকা। সেই প্রকল্পে নজর ছিল প্রত্যেকের। টাকা বরাদ্দ হওয়ার পর থেকেই ‘কমিশন’ নিয়ে অঙ্ক কষতে শুরু করে দেন তৃণমূল কাউন্সিলাররা। পিছিয়ে ছিলেন না চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানও। সেই টাকার ভাগ বাটোয়ারা নিয়েই তুমুল দ্বন্দ্ব শুরু হয় নিজেদের মধ্যে। সেই সূত্রপাত। এরপর আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যান কাউন্সিলারা। কার্যত কোণঠাসা হয়ে পড়েন চেয়ারম্যান। পাল্লা ভারী থাকে চেয়ারম্যান-বিরোধী কাউন্সিলারদের। চেয়ারম্যানের বিভিন্ন ‘খুঁত’ তাঁরা খুঁজে বের করতে থাকেন। বছর দেড়েক আগে রাজ্যের শীর্ষ নেতৃত্ব সহ প্রশাসনিক মহলে পুরসভার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাউন্সিলারদের একাংশ অভিযোগ তোলে। অভিযোগপত্র রাজ্যের শীর্ষ নেতৃত্ব সহ বিভিন্ন প্রশাসনিক মহলে জমা দেন। বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করে দল। যদিও জেলা শীর্ষ নেতৃত্ব স্রেফ সাবধান করেই ছেড়ে দেন চেয়ারম্যানকে। তাতে ব্যাপক ক্ষুব্ধ হন অন্যান্য কাউন্সিলাররা। তাঁকে শায়েস্তা করতে চেয়ারম্যানের বিভিন্ন দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁরা প্রমাণ এককাট্টা করতে থাকেন।
চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কাউন্সিলারদের একাংশের অভিযোগ ছিল, পুরসভার বিভিন্ন টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম করেছেন চেয়ারম্যান। টেন্ডার ছাড়াই লক্ষ লক্ষ টাকা প্রকল্পের কাজ করিয়েছেন। পুরসভার বিভিন্ন পদে ‘অবৈধ’ নিয়োগ, মার্কেট কমপ্লেক্স সহ বিভিন্ন পুর-সম্পত্তি নিজের ঘনিষ্ঠদের স্বল্পমূল্যে লিজ দেওয়া, জয়চণ্ডী পাহাড় পর্যটন উত্সবে সাফাইয়ের নাম করেই লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করেছেন চেয়ারম্যান। শুধু তাই নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাধের ‘মা ক্যান্টিনে’ স্বল্প লোককে পরিষেবা দিয়ে ভুয়ো বিল আদায়ের মতো গুরুতর অভিযোগও রয়েছে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগকে হাতিয়ার করেই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব জমা দেন সাত কাউন্সিলার। তারপরেই পুরসভার নির্বাচিত বোর্ড ভেঙে প্রশাসককে দায়িত্ব দিয়েছে রাজ্য।
তবে, যাঁরা অভিযোগ করছেন, তাঁরাও যে একেবারে ‘সৎ’ নন, সেই প্রমাণও মেলে জেলাশাসকের তরফে রাজ্য পুর ও নগরোন্নয়ন দপ্তরে পাঠানো একটি রিপোর্টে। কাউন্সিলারদের একাংশও বিভিন্ন ‘অসৎ’ কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত বলে একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। যদিও এনিয়ে অনাস্থা আনা কাউন্সিলারদের অন্যতম প্রণব দেওঘরিয়া বলেন, কাউন্সিলারদের বিরুদ্ধে যদি দুর্নীতির অভিযোগ থাকে তাহলে সঠিকভাবে তদন্ত হোক। তাহলেই বোঝা যাবে কে আসল দুর্নীতি করেছে। বিদায়ী চেয়ারম্যান তরণী বাউরি বলেন, দুর্নীতি নয়, চেয়ার দখলের জন্যই এই লড়াই। কয়েকজন কাউন্সিলার নিজেকে চেয়ারম্যানের চেয়ারে বসার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
চেয়ারম্যান ঘনিষ্ঠ আবার অনেকের সাফাই, পুরসভার এক সরকারি আধিকারিকের জন্যই চেয়ারম্যান তরণী বাউরির এই পরিণতি! ওই আধিকারিকই চেয়ারম্যানের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেয়েছেন! অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ যাই হোক না কেন, এসবের তদন্ত চাইছেন রঘুনাথপুর শহর কংগ্রেস সভাপতি তারকনাথ পরামানিক। তিনি বলেন, গত তিন বছরে পুরসভায় যে হারে দুর্নীতি হয়েছে তার সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। জনগণের টাকা যারা নয়ছয় করেছে, প্রত্যেকের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
বিজেপি কাউন্সিলার দীনেশ শুক্লা বলেন, পুরসভার দুর্নীতির কথা বললে শেষ হবে না। টেন্ডার হওয়ার আগেই কাজ হয়ে গিয়েছে। বিজেপি ছেড়ে কথা বলবে না। পুরসভার দুর্নীতির পর্দা ফাঁস করতে হাইকোর্টে যাব।