নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: গরমের দুপুরে ছায়ায় ঘেরা থাকে পূর্ণ দাস রোড। দক্ষিণ কলকাতায় কালো পিচের এই রাস্তাটির দু’পাশে ছড়িয়ে সুন্দর সব ফ্ল্যাট বাড়ি, কফিশপ। কে বলবে, দেড়শো-দুশো বছর আগে এই এলাকা ছিল বাদাবন। বাঘ ঘুরে বেরাত। বাঘের মতোই ঘুরত হিংস্র দস্যুদল। এখন বাদাবন কল্পনাতেও আসে না। বাঘটাঘের তো প্রশ্নই নেই। তবে এককালের ত্রাস সে ডাকাতদের ছাপ খাস কলকাতায় দস্তুরমতো রয়ে গিয়েছে। জমজমাট গড়িয়াহাটে মনোহর পুকুর রোডের নামকরণ এক ডাকাতের নামেই। মনোহর ছিলেন সে কালের এক দুর্দান্ত ডাকাত। রাস্তাটি শুধু নয়, পূর্ণ দাস রোডে রয়েছে ডাকাত কালীবাড়িও। সেই কালীর সঙ্গে মনোহর ডাকাতের নাম জুড়ে। রাস্তার উপর বাগান ঘেরা সে কালীবাড়ির পিছনে লুকিয়ে গা ছমছমে ইতিহাস। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তর ‘বাংলার ডাকাত’ বইয়ে মনোহর ডাকাতের কাহিনি জানা যায়। তখন পলাশীর যুদ্ধ শেষ হয়েছে। তবে কোম্পানি শাসন শুরু হয়নি। এই এলাকা জনমানবশূন্য। লোকচক্ষুর আড়ালে বসবাস করছেন মনোহর বাগদী। তখন বহু দূর থেকে কালীঘাটে ঠাকুর দেখতে আসত ভক্তরা। সন্ধ্যায় মনোহরের দলবল কখনও আশপাশ অঞ্চলে তাদের উপর, কখনও নদীপথে উত্তরপাড়া, চন্দননগর, বাঁশবেড়িয়া, নদীয়ার দিকে ডাকাতি করতে যেত। তাঁর বাড়ি থেকে অল্প দূরেই এক কালীমন্দির। ডাকাতরা কালীকে কঙ্কালমালিনী বলে ডাকত। ছাগ, মহিষ বলি তো হতোই, পূর্ণিমা-অমাবস্যায় নরবলিও হতো। মনোহর ডাকাতি করে ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন। দস্তুরমতো বড়লোকও। সেই দুর্দান্ত মনোহরের জীবন আকস্মিক এক ঘটনায় যায় আমূল পাল্টে। একদিন হোগলা বন দিয়ে যাচ্ছিলেন এক মহিলা, বৃদ্ধ ও শিশু। আচমকা বাঘের হানা। বৃদ্ধকে আঁচড়ে কামড়ে মেরে ফেলল বাঘ। তখন ওই পথ দিয়েই দলবল নিয়ে ফিরছিলেন মনোহর। জখম মহিলা ও শিশুটিকে দেখতে পেয়ে উদ্ধার করেন। নিজের বাড়ি আনেন। শুশ্রুষার পরও মহিলাকে বাঁচানো যায়নি। কিন্তু শিশুপুত্রটি যায় বেঁচে। মনোহরের এক পিসি ছিলেন। তিনি পরামর্শ দিলেন বাচ্চাটিকে গলা টিপে মেরে ফেলতে। কিন্তু দুধের শিশুটির প্রতি স্নেহান্ধ হয়ে পড়েন মনোহর। বাচ্চাটিকে বড় করে তুলতে দিলেন ডাকাতি ছেড়ে। সে ছেলের নাম হল হারাধন। ভালো করে পড়ালেখা শিখবে বলে খ্রীস্টানদের স্কুলে ভর্তিও করা হল। মনোহর চাষাবাদ শুরু করলেন। জীবনের শেষ ভাগে মৃত্যুর আগে নিজের জমানো গুপ্তধনের সন্ধান দিয়ে গেলেন হারাধনকে। সঙ্গে আদেশ, গরিবের জন্য পুকুর খননের। শোনা যায়, পুকুর খুঁড়েওছিলেন হারাধন। তা স্বাভাবিকভাবেই এখন নেই। তবে কালী মন্দিরটি রয়ে গিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, এটি মনোহর ডাকাতের মন্দির। সে কালীবাড়ির গেট দিয়ে প্রবেশ করলে বাঁ দিকে সাজানো জবা বাগান। সামনের উঠোনে বলির হাড়িকাঠ। এক মহিলা বলেন, ‘অনেক পুরনো মন্দির। মনোহর ডাকাতের মন্দির।’ মন্দিরের বাইরে প্রতিষ্ঠা সাল লেখা, ‘১৮৯১’। ওই চত্বরে এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে আরও রয়েকটি কালীমন্দির। কিন্তু মনোহরের মন্দির এই একটিই। জমজমাট গড়িয়াহাটে ডাকাত সম্রাটের মন্দির! কলকাতার মানুষ এখনও সে কালীর কাছে পুজো দিতে আসেন। এখনও মন্দিরের যূপকাষ্ঠ শোনায়, সেদিনের নরবলির সে গা ছমছমে কাহিনি। নিজস্ব চিত্র