অর্ঘ্য বিশ্বাস, ক্রান্তি
মুড়ি সঙ্গে নানা রকম মশলার ঝোলা কাঁধে নিয়ে যখন ময়দানে নেমেছিলেন তখন পাঁচ পয়সা দাম ছিল বাঙালির অন্যতম প্রিয় স্ন্যাকস ঝালমুড়ির। এখন অবশ্য দশ টাকায় বিক্রি করেন এক ঠোঙা ঝালমুড়ি।
দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরে তিস্তা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেলেও পঁচাত্তর ছুঁইছুঁই অরুণ বিশ্বাসের জীবনের গল্পটা একই রয়ে গিয়েছে। এখনও চা বাগানের বা বনবস্তির কোনও বাচ্চা তাঁর কাছে ঝালমুড়ি খাওয়ার আবদার করলে নির্দ্বিধায় বিনাপয়সায় তা বানিয়ে দেন। তিন প্রজন্মকে ঝালমুড়ি খাইয়ে আজও সুদিনের আশায় পথ চেয়ে রয়েছেন তিনি।
গজলডোবা-শিলিগুড়িগামী ক্যানাল রোড সংলগ্ন গজলডোবা সেতুর পাশে স্ত্রী শেফালী বিশ্বাসের সঙ্গে থাকেন তিনি। স্কুল ও কলেজ পড়ুয়াদের সঙ্গে খুব ভাব অরুণের। ছুটির ঘণ্টা বাজলে তাঁদের প্রিয় হয়ে গিয়েছিল অরুণকাকুর ঝালমুড়ি।
আজও অনেক প্রাক্তন পড়ুয়ার সঙ্গে দেখা হলে স্মৃতির পাতা থেকে সেই সমস্ত মুহূর্ত ফুটে ওঠে অরুণের চোখে। জানালেন, মুখে ফুটে ওঠা বয়সের বলিরেখা আর ভাঙাচোরা চশমার ফ্রেম দেখেও যখন অনেকে তাঁকে চিনতে পারেন, তখন জীবনের সবটুকু দুঃখ যেন ধুয়ে যায়।
স্কুল গেটের বাইরের মুখগুলো বদলে গেলেও ঝালমুড়ির স্বাদটা একই ভাবে প্রিয় রয়ে গিয়েছে সবার কাছে। তাঁর কথায়, ‘এক সময়ে বিভিন্ন স্কুলের সামনে ঘুরে ঘুরে মুড়ি বিক্রি করেছি। বয়সের ভারে এখন ওতো পেরে উঠি না। অনেকেই আজ কত বড় হয়ে গিয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকের ছেলেমেয়েরাই এখন সেই সব স্কুলে পড়ে।’
ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে মুড়ি বিক্রি শুরু করেন অরুণ। নৌকো চেপে তিস্তা পারাপার করে পৌঁছে গিয়েছেন গজলডোবা, ক্রান্তি, মালবাজার, রাজগঞ্জ–সহ আশপাশের একাধিক এলাকার অলিগলিতে।
মুড়িওয়ালাকে দেখে চা–বাগান কিংবা বনবস্তির অনেকে খুদেরা আবদার করে বসত ‘ঝালমুড়ি খাব’। অনেকের কাছে আবার টাকাও থাকত না। তবুও অরুণ হাসিমুখেই ঝালমুড়ি বিলিয়ে দিতেন। তাঁর জীবন যুদ্ধের কাহিনি শুনে অরুণকে সমস্ত সরকারি সুযোগ–সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদের কর্মাধক্ষা মহুয়া গোপ।
গরমের মধ্যে ভারী দুটো ব্যাগ কাঁধে, হেঁটে গজলডোবা সেতু পারাপার করতে গিয়ে তখন তাঁর কপালে ঘাম। বোঝা গেল খানিকটা হাঁপও ধরেছে। তবে মুখে চওড়া হাসি। বললেন, ‘এই মুড়ি বিক্রি করেই মেয়েদের পড়াশোনা করিয়েছি, তাঁদের বিয়ে দিয়েছি।’
আর্থিক অনটনের মধ্যেও স্ত্রীর সহযোগিতা ছাড়া জীবনটা এ ভাবে হেসেখেলে কাটাতে পারতেন না বলেই জানালেন তিনি। স্ত্রী শেফালী বিশ্বাসের কথায়, ‘অনেক বারণ সত্ত্বেও দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে ঝালমুড়ি বিক্রি ওর যেন অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ তবে এই কাজে ও শান্তি পেলে আমিও খুশি।’