• পেট-ভরা খাবার নেই, ছ’জনের সংসারে দিনে বরাদ্দ ৩০ টাকা!
    এই সময় | ২৩ মে ২০২৫
  • প্রশান্ত পাল, পুরুলিয়া

    মাথার উপরে ৪০ ডিগ্রির গনগনে রোদ। গাছের ছায়ায় বসে খেলা করছিল দুই ভাই–বোন, প্রদীপ ও রূপালি। কাছে যেতেই চোখ তুলে দেখল। দু–চার কথার ফাঁকে জানা গেল, সকাল থেকে খাবার জোটেনি, বাবার পথ চেয়ে আছে।

    তাই খেলায় বিশেষ মন নেই। খানিক পরে দূর থেকে বাবাকে আসতে দেখে ছুটে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরল দু’জনে। এই বাবা — কার্তিক শবর।

    পুরুলিয়া জেলার বলরামপুর ব্লক। সেখানকার পঞ্চায়েত অফিসের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে মসৃণ জামশেদপুর-ধানবাদ জাতীয় সড়ক। সেই জাতীয় সড়কের ছোটউরমা মোড় থেকে বাঁয়ে বাঁক নিয়ে খয়রাডি, ডুমারি, লায়াডি পার হয়ে আঁকাবাঁকা যে পথ হাড়জোড়া গ্রামের শবর টোলায় গিয়ে মিশেছে, সেখানেই কার্তিকের সাকিন।

    সেই টোলায় ৩২টি ঘর। মেরেকেটে ১৪১ জন মানুষের বাস। এ বাড়ি–সে বাড়ি ঘুরে অভাবের এমন এক নিকষ অন্ধকারের খোঁজ মিলল, যেখানে ‘উন্নয়ন’–এর আলোটুকু পৌঁছতেই পারেনি।

    ২০১১–তে রাজ্যে পালাবদলের আগে এই বলরামপুরের পরিচিতি ছিল মাও সন্ত্রাসের ধাত্রীভূমি হিসেবে। জঙ্গলমহলের এই অভাব–বঞ্চনাকেই হাতিয়ার করেছিল মাওবাদী নেতারা। গড়ে তুলেছিল সশস্ত্র আন্দোলন।

    তৃণমূল সরকার আসার পরে জঙ্গলমহলের সামগ্রিক চিত্রটা অনেকাংশে বদলে গিয়ে ভাত–কাপড়ের সংস্থান হতে শুরু করে। দু–বেলা দু–মুঠো খেতে পাচ্ছেন মানুষ। তবু, তারই ফাঁকে উঠে আসে হাড়জোড়ার ভয়ঙ্কর ছবি। যেখানে অপুষ্টির শিকার মানুষ। কেমন সেই অপুষ্টির ছবি?

    ‘আমি কাজে বেরিয়েছিলাম। কাজ থেকে কখন দুটো খাবার আনব, সেই অপেক্ষায় ছেলেমেয়ে বসে থাকে। আজ কাজে গিয়ে কিছু মুড়ি পেয়েছি। এখন তিনজনে মিলে খাব’, এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে থামলেন কার্তিক। পরনে স্লিভলেস আকাশি টি–শার্ট, ৩০ ছুঁই ছুঁই শরীরে অপুষ্টির থাবা।

    পরিবারে স্ত্রী, ছেলে–মেয়ে ও মা। মোট পাঁচ জন। একমাত্র রোজগেরে কার্তিক। মাসে গড়ে সাত দিন কাজ মেলে। একদিন কাজ করলে ১৫০ টাকা। মাসে ১০৫০ টাকা। রেশন কার্ড রয়েছে কার্তিকদের। সেখান থেকে চাল পান। তা সত্ত্বেও বাইরে থেকে প্রতি মাসে ১৫ কেজি চাল কিনতে হয়।

    সেই চালের দাম কেজি প্রতি ২৭ টাকা। মাসে ৪০৫ টাকা। বাকি যে টাকা পড়ে থাকে, তা দিনের হিসাবে ২০ টাকা। তাতে তেল, নুন, আলু, মুড়ি কতটা হয়, তা সহজেই অনুমেয়। শবরদের মধ্যে অনেকের আবার নেশা করার অভ্যাসও রয়েছে। তা কিনতেও তো টাকা লাগে। নেশার প্রসঙ্গ এড়িয়ে কার্তিক বলেন, ‘রেশনে যেটুকু চাল মেলে, তাতে পেট ভরে না। বাজার থেকে চাল, তেল, নুন, মশলা সবই কিনতে হয়। তাতেও কুলোয় না।’

    সাতসকালেই দিনমজুরির খোঁজে বেরিয়েছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব শকুন্তলা শবর। বুধবার ধান কাটার কাজ জুটেছে দিন পাঁচেক পরে। দুপুরে বাড়ি ফেরার পথে জানালেন স্বামী মথুর মারা গিয়েছেন কয়েক মাস আগে। জ্বর হয়েছিল। শরীরও খুব দুর্বল ছিল। আর কাজ করতে পারতেন না। এখন শকুন্তলা ও তাঁর ছেলে গুণধর কাজে বেরোন।

    প্রতিবার কাজেই যে ১৫০ টাকা মিলবে, তেমনও নয়। শকুন্তলার কথায়, ‘পাঁচদিন আগে গাঁয়েই গোরুর গাড়িতে গোবর বোঝাইয়ের কাজ মিলেছিল বটে। চারজন মিলে সেই কাজ করে মোট ১৫০ টাকা পারিশ্রমিক মিলেছে। সেটা চারজনের মধ্যে ভাগ হয়েছে।’

    গুণধরের অভিযোগ, ‘এখন কাজ কোথায়? যখন যেমন জোটে, তেমন করি। কোনও মাসে আট-দশ দিন, কোনও মাসে তাও নয়। শাকসবজি কেনার ক্ষমতা নেই। কখনও কিছু শাক জোটাই বা কিনে আনি। কিছু খেতে ইচ্ছে হলে ছেলেমেয়েরা আবদার করে। দিতে পারি না। খুব খারাপ লাগে।’

    শকুন্তলা, গুণধর ছাড়াও বাড়িতে গুণধরের স্ত্রী কল্পনা, তিন ছেলে–মেয়ে। তাদের বয়স ৮ থেকে ১৪। কল্পনা কাজে বেরোন না। শকুন্তলা ও গুণধর মিলে মাসে বড়জোর কাজ জোটে ১৪ দিন। মাসে প্রায় ২১০০ টাকা। রেশন কার্ড নেই। পুরো চালটাই কিনতে হয় বাইরে থেকে। দু’বেলাই ভাত খান তাঁরা।

    মাসে প্রায় ৪৫ কেজি চাল লাগে। বাজারের হিসাবে চাল কিনতে লাগে প্রায় ১২০০ টাকা। পড়ে থাকে ৯০০ টাকা। দিনের হিসেবে ৩০ টাকা। তা দিয়ে ছ’জনের কী হবে? এক একজনের ভাগে তো প্রায় পাঁচ টাকা।

  • Link to this news (এই সময়)