প্রশান্ত পাল, পুরুলিয়া
২০০৪ সাল। রাজ্যে তখন বাম–জমানা। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ির কাছে আমলাশোল গ্রাম উঠে এল শিরোনামে। অনাহারে ও অপুষ্টিতে মারা গেলেন একাধিক গ্রামবাসী। তাঁদের ডেথ সার্টিফিকেটে উঠে এল অনাহারের কথা।
২১ বছর পরে একই অপুষ্টির অভিযোগ উঠে আসছে পুরুলিয়ার বলরামপুর ব্লকের হাড়জোড়া গ্রাম থেকে। গ্রামের উপান্তে শবর টোলা। ৩২টি শবর পরিবারে একশোর বেশি মানুষ। অপুষ্টিতে মৃত্যু মানে তো সাংঘাতিক অভিযোগ! প্রমাণ কোথায়?
শবরদেরই লেখা একটি চিঠি হাতে এসেছে ‘এই সময়’–এর। যেখানে একযোগে তাঁরা গ্রামে খাদ্যাভাবের অভিযোগ করেছেন। লিখেছেন, বাসস্থান–চিকিৎসা — কিছুই নেই সেখানে। গত বছরের অক্টোবরে জেলাশাসককে লেখা সেই চিঠিতে অভিযোগ করা হয়েছিল, বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছেন সাতজন। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন আরও দু’জন। অভিযোগ, গ্রামের অবস্থাপন্নরা আবাস যোজনায় বাড়ি পেলেও তাঁরা পাচ্ছেন না।
আর সেই অভিযোগ পাঠানোর সাত মাস পরে সেই গ্রামেই দেখা পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান সহদেব মাহাতোর সঙ্গে। তাঁর অভিযোগ, ‘গত এক বছরে মোট ন’জনের মৃত্যু হয়েছে।
খাবারের অভাবে অপুষ্টির শিকার হয়ে এঁদের শরীরে যে রোগ বাসা বাঁধছে, এবং তার জেরে যে একের পর এক মৃত্যু ঘটছে, গত অক্টোবরে প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দফতরকে তা লিখিত ভাবে জানানো হয়েছিল। গ্রামে স্বাস্থ্য শিবির করার দাবিও জানানো হয়। তারপরেও মৃত্যুর ঘটনা অব্যাহত।’
শবরদের অভিযোগ, গ্রামে কাজ নেই। দীর্ঘদিন বন্ধ একশো দিনের প্রকল্পের কাজ। রেশন থাকলেও অনেকেই খাদ্যপণ্য পান না। কারণ, রেশন কার্ড থাকলেও আধার কার্ড নেই। আধার লিঙ্ক না হওয়ায় রেশনের চাল-আটা অধরা।
বলরামপুরের বিডিও সৌগত চৌধুরী বলেন, ‘কিছুদিন আগে হাড়জোড়া গ্রামের শবর সম্প্রদায়ের মানুষজন ব্লক প্রশাসনের কাছে কিছু দাবি–দাওয়া নিয়ে এসেছিলেন। তখনই সমস্যাগুলি সামনে আসে। আধার কার্ডের সমস্যার কথা শুনে প্রশাসন ৩৫ জনের আধার কার্ড তৈরি করে দিয়েছিল। বাকিদের তালিকাও চাওয়া হয়েছিল। ওঁরা আর যোগাযোগই করেননি। সমস্যাগুলি ফের খতিয়ে দেখা হবে।’
স্থানীয় বাসিন্দারা তো অপুষ্টির শিকার হয়ে গত এক বছরে ন’জনের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করছেন। বিডিও বলেন, ‘ওঁরা যখন আমাদের কাছে এসেছিলেন, তখনই কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনা সামনে আসে। ব্লক স্বাস্থ্য দপ্তরের রিপোর্ট মোতাবেক পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।’
জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অশোক বিশ্বাসের কথায়, ‘গত এক বছরে ওই গ্রামে বা টোলায় কতজনের মৃত্যু হয়েছে এবং তাঁদের মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখা হবে। তাঁরা অপুষ্টিজনিত রোগের শিকার ছিলেন কিনা তাও দেখা হবে।’
মাস খানেক আগে মৃত্যু হয়েছে ষাটোর্ধ্ব চাঁদমণি শবরের। তাঁর ছেলে লালমোহন বলছিলেন, ‘মা ঘরেই মারা গিয়েছে। অনেকদিন আগে থেকেই শরীর দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকেই খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। গ্রামে কাজ কোথায়? রোজগার নেই। কী করে খাওয়াব? যে দিন থেকে আধার কার্ডের সঙ্গে লিঙ্ক শুরু হয়েছে, সে দিন থেকেই আর আমরা রেশনের মাল পাই না।’
গ্রাম ঘুরে জানা গিয়েছে, অপুষ্টিতে হাঁটাচলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন আনন্দ শবর। বাড়িতে কেউ ছিলেন না। পাশের বাঁধে স্নান করতে গিয়ে তলিয়ে যান। বাড়ির লোক তো তাঁকে দু’দিন খুঁজেই পাননি। তিনদিন পরে দেহ ভেসে উঠেছিল।
গ্রামের রেশন ডিলার গোলাপি মাহাতোর মেয়ে প্রগতি বলেন, ‘যে দিন থেকে আধার কার্ডের যোগ বাধ্যতামূলক হয়েছে, সে দিন থেকেই অনেকের রেশন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ব্লকের খাদ্য পরিদর্শককে জানিয়েছি।’ বারে বারে চেষ্টা করেও বড়উরমা গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান জানকী মাহাতোর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
তবে এই এলাকার তৃণমূলের পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য সুভাষ দাস গোস্বামী শবরদের এই দুর্দশার কথা মেনে নিয়ে বলেছেন, ‘ওঁদের সমস্যার কথা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বা বিডিও–কে বলেছি। গুরুত্ব দেননি। শবররা তো আদিম জাতি। আধার কার্ড নেই। জন্মের শংসাপত্র নেই। ওঁদের জীবন-জীবিকার জন্য আলাদা ভাবে নজর দেওয়া দরকার, যেটা হয়নি।’
বলরামপুরের বিজেপি বিধায়ক বাণেশ্বর মাহাতোর অভিযোগ, ‘হাড়জোড়া গ্রামের শবরদের দুরবস্থার কথা প্রশাসনের নজরে এনেছি। অনেকে রেশন থেকে বঞ্চিত। খাবার জোটে না। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও অনেকের নেই। অপুষ্টির শিকার হচ্ছেন ওঁরা। আদিম জনজাতি। জঙ্গলে এঁরা যতটা স্বচ্ছন্দ, প্রশাসনের কাছে একেবারেই নয়। ডাকলেও আসতে চাইবে না। এঁদের মৃত্যুর ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়। প্রশাসনকে গ্রামে গিয়ে এঁদের সমস্যা সরেজমিনে দেখে সমাধান করতে হবে।’
এই রাজনৈতিক চাপান-উতোরের মাঝে দুপুর গড়িয়ে ঘলরে ফিরে অসুস্থ মা সারথি শবরের শয্যার কাছে ছুটে যান বড় ছেলে নেপাল। পঁয়তাল্লিশ পেরনো সারথি বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ। শরীরে অপুষ্টির ছাপ। নেপাল বলেন, ‘মা খুব দুর্বল হয়ে গিয়েছে। উঠে বসতেও পারে না। জলটুকুও ভালো করে খেতে পারছে না। জ্বরেও ভুগছে মাঝে মাঝে। জানি না, মাকে কতদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারব।’