প্রদীপ চক্রবর্তী, রিষড়া
পাক রেঞ্জারদের হাতে বন্দি হওয়ার পরে একপ্রকার ধরেই নিয়েছিলেন, আর হয়তো কোনও দিনই স্ত্রী–পুত্র কিংবা বাবা–মায়ের সঙ্গে তাঁর দেখা হবে না। সীমান্তের কাছ থেকে চোখে কাপড় বেঁধে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে তাঁকে রাখা হয়েছিল পাক সেনা আবাসে একটা ছোট্ট ঘরে।
সেখানে বসে বোঝার উপায় ছিল না, কখন সকাল হচ্ছে, আর কখন সন্ধ্যা নামছে। তবে রক্ষীদের কাছ থেকে টুকটাক বাইরের খবর পেতেন। তারই সুবাদে জানতে পেরেছিলেন, ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে রীতিমতো যুদ্ধ বেঁধে গিয়েছে।
সেটা শোনার পরে দেশে ফেরার যে ক্ষীণ আশাটুকু ছিল, সেটাও চলে গিয়েছিল। সেই দুঃসময় পার করে অবশেষে শুক্রবার রাতে রিষড়ার বাড়িতে ফিরলেন সদ্য পাক বাহিনীর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া বিএসএফ জওয়ান পূর্ণম সাউ। নিজের রাজ্যে ফিরে রীতিমতো বীরের সংবর্ধনা পেলেন তিনি। তাঁকে ঘিরে মানুষের আবেগ ও উন্মাদনা ছিল চোখে পড়ার মতো।
পাকিস্তানে বন্দি থাকার সময়ে তিনি কী ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেটা জানার জন্য অনেকেই উদগ্রীব ছিলেন। পূর্ণমকে কাছে পেয়ে সাংবাদিকরাও বার বার সেটাই জানতে চেয়েছিলেন। যদিও সরকারি বাধ্যবাধকতার কারণে তা নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। তবে তিনি বলেন, ‘ভারতে আমার দ্বিতীয় জন্ম হলো।’
পাকিস্তানের হাতে বন্দি হওয়ার পরে কি কিছুটা ভয় লেগেছিল? অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পূর্ণম জানালেন, ‘আমরা দেশের সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকি, তাই ভয় পাই না। আমরা ভয় পেলে দেশের মানুষকে সুরক্ষা দেবো কী করে? সেনাদের ভয় পেতে নেই।’
এ দিন বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে হাওড়া স্টেশনের নিউ কমপ্লেক্সে ১৭ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পূর্বা এক্সপ্রেসের বি-৬ কোচ থেকে বেরিয়ে আসেন পূর্ণম। আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছিলেন পূর্ণমের বন্ধু ও আত্মীয়রা। ছিলেন হাওড়া সিটি পুলিশ এবং জিআরপি’র আধিকারিকরা।
ট্রেন থেকে নামতেই পূর্ণমকে জড়িয়ে ধরেন বাবা ভোলানাথ সাউ। দু’জনের চোখেই তখন আনন্দের অশ্রু। সবমিলিয়ে স্টেশন চত্বরে একটা আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। পূর্ণমকে এক পলক দেখার জন্যে সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়৷ তারই মধ্যে কেউ কেউ ‘ভারতমাতা কী জয়’ বলে জয়ধ্বনি দেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে পূর্ণম বলেন, ‘বাবা–মায়ের কাছে ফিরতে পারছি, এতে আমি খুব খুশি।’ হাওড়া থেকে বাড়ি আসার পথে সালকিয়ার একটি দোকানে পূর্ণমকে মিষ্টি খাওয়ানো হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ রিষড়া বাগখালে পৌঁছান পূর্ণম। সেখানে তৃণমূলের তরফে রাজকীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
হাজির ছিলেন শ্রীরামপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি বিধায়ক অরিন্দম গুঁই, রিষড়া পুরসভার উপপুরপ্রধান জাহিদ হাসান খান। এরপরে পূর্ণমকে হুডখোলা জিপে তুলে রিষড়া শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ঘোরানো হয়। সন্ধ্যা বাজার, জিটি রোড, এনএস রোড, রবীন্দ্র ভবন, রিষড়া পুরসভা হয়ে রাত ৯টা নাগাদ পিটি লাহা স্ট্রিটে নিজের বাড়িতে পৌঁছায় পূর্ণম।
তাঁকে দেখার জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করছিলেন প্রচুর মানুষ। বাড়িতেও ভিড় করেছিলেন অনেকে। ভিড়ের ঠেলায় এবং অতিরিক্ত গরমে রাতের দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন পূর্ণমের স্ত্রী রজনী।
সকাল থেকে পূর্ণমের রিষড়ার বাড়িতে ছিল উৎসবের পরিবেশ। তেরঙা এলইডি আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে সাউবাড়ি। বাড়িতে হাজির আত্মীয়স্বজনরা। সাত সকালেই স্নান করে গৃহদেবতার পুজো করেন মা দেবন্তী। মাঙ্গলিক আলপনাও দেন।
তারই ফাঁকে তিনি বললেন, ‘এতদিন মন ভরে শুধু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি, আমার ছেলেকে আমার কোলে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। অনেক দিন পর ছেলেকে নিজের সামনে বসিয়ে ওঁর প্রিয় লুচি আর তরকারি খাওয়াবো। শেষ পাতে থাকবে দই মিস্টি। রবিবার হবে মাংস ভাত।’
রিষড়ার পুরপ্রধান বিজয় সাগর মিশ্র বলেন, ‘পূর্ণম রিষড়ার গর্ব। আজ রিষড়াবাসীর খুব আনন্দের দিন।’