সুমন ঘোষ, খড়্গপুর
সামুদ্রিক মাছে রয়েছে ক্যান্সার প্রতিরোধ ক্ষমতা। এমনই এক মাছের কথা উঠে এল গবেষণায়। সেখানে দেখা গিয়েছে, সামুদ্রিক তাপড়া মাছের মধ্যে ‘লিনোইলাইডিক’ নামে যে ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে তা ক্যান্সারের সেলের কার্যক্ষমতাকে নষ্ট করতে সক্ষম।
গবেষকরা এই পরীক্ষাটি করার জন্য দু’টি ক্যান্সার সেল লাইন ব্যবহার করেন। একটি এমসিএফ-৭ এবং অন্যটি এমডিএ-এমবি-২৩১। দু'টিই ব্রেস্ট ক্যানসারের কোষ। এই কোষগুলিকে চার ভাগে ভাগ করে পরীক্ষা করা হয়। প্রথম ক্ষেত্রে ক্যান্সার কোষগুলি সাধারণ ভাবে রাখা হয়। বাকি তিনটি ক্ষেত্রে কোষগুলির উপরে বিভিন্ন ডোজে ‘লিনোইলাইডিক অ্যাসিড’ প্রয়োগ করা হয়।
তাতে দেখা যায়, ল্যাকটেট ডিহাইড্রোজিনেস নিঃসরণ কমছে। নাইট্রিক অক্সাইড উৎপাদন বাড়ছে এবং ভেঙে যাচ্ছে ক্যান্সার কোষের ডিএনএ স্ট্যান্ড। গবেষকরা জানাচ্ছেন, তা থেকেই পরিষ্কার, কোষপতনের ফলে ক্যান্সার কোষ কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে।
গবেষক শ্রাবণী প্রধান জানান, ‘লিনোইলাইডিক অ্যাসিড’ ব্যবহার না করা কোষগুলির ক্ষমতা আগের মতোই থেকে গিয়েছে। অর্থাৎ ক্যান্সার কোষ সেখানে ১০০ শতাংশ সক্রিয়। উল্টো দিকে বিভিন্ন ডোজে ‘লিনোইলাইডিক অ্যাসিড’ ব্যবহার করায় ক্যান্সার কোষের কর্মক্ষমতা ১০.০৪ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
নাইট্রিক অক্সাইড উৎপাদনের ক্ষমতা বেড়ে হচ্ছে ১১.০৭ মাইক্রোমোল। এমএল থেকে ২৬.৭৫ মাইক্রোমোল/এমএল। তারই সঙ্গে ডিএনএ স্ট্যান্ড ভেঙে যাওয়ায় কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে ক্যান্সারের কোষ।
পাশাপাশি কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে টিউমার প্রতিরোধী জিনের। শ্রাবণী বলেন, ‘লিনোইলাইডিক অ্যাসিড প্রয়োগের ফলে p53-এর কর্মক্ষমতা বেড়ে যাচ্ছে অনেকটাই। যা টিউমার প্রতিরোধক জিন। যার ফলে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিও ঘটছে না।’
পরীক্ষাগারে পরীক্ষার পরে ইঁদুরের দেহেও প্রয়োগ করে দেখেন গবেষকরা। গবেষকরা জানান, ২৪টি ইঁদুরকে চার ভাগে ভাগ করে তাদের দেহে ইনজেক্ট করা হয় ক্যান্সারের কোষ। একটি গ্রুপকে সাধারণ খাবার দেওয়া হয়।
অন্য তিনটি ভাগের ইঁদুরদের সাধারণ খাবারের পাশাপাশি বিভিন্ন মাত্রায় তাপড়া মাছের তেল খাওয়ানো হয়। দেখা যায়, সেক্ষেত্রেও একই ফল মিলছে। তাপড়া মাছের তেল না-খাওয়ানো ইঁদুরের দেহে টিউমার বেড়ে হয়েছিল ১৫ মিলিমিটার।
সেখানে বিভিন্ন ডোজে তাপড়া মাছের তেল খাওয়ানো ইঁদুরের ক্ষেত্রে টিউমার দেখা গিয়েছে সাত মিমি, ছ'মিমি ও চার মিমি। তার পরে সেই টিউমার পরীক্ষা করেও দেখা গিয়েছে আগের মতোই ল্যাকটেট ডিহাইড্রোজেন নিঃসরণ কমেছে। নাইট্রিক অক্সাইড উৎপাদন বেড়েছে। ভেঙে যাচ্ছে ক্যান্সার কোষের ডিএনএ স্ট্যান্ড। কোষপতনের ফলে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে ক্যানসার কোষ।
এ ক্ষেত্রে আরও একটি প্রশ্ন থেকে যায়। যদি মানবদেহে এর প্রয়োগ করা হয়, সে ক্ষেত্রে কি কোনও বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে? যদিও এটি এখনও মানব দেহে প্রয়োগ করে দেখা হয়নি। তবুও গবেষকদের দাবি, মানবদেহে এর কোনও বিরূপ প্রভাব পড়বে না। কেন? গবেষক শ্রাবণীর দাবি, ‘মানবদেহে প্রয়োগ না-করলেও ‘পেরিফেরাল ব্লাড লিম্ফোসাইট’, যা সাধারণ মানবকোষ, তাতে লিনোইলাইডিক অ্যাসিড প্রয়োগ করে আমরা দেখেছি।
দেখা গিয়েছে, ল্যাকটেট ডিহাইড্রোজিনেস নিঃসরণ এবং নাইট্রিক অ্যাসিড উৎপাদন হচ্ছে স্বাভাবিক। ডিএনএ স্ট্যান্ডও ভাঙছে না। ফলে মানুষের সাধারণ কোষ নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি নেই। শুধু ক্যান্সার কোষই নষ্ট করছে এই ফ্যাটি অ্যাসিড।’ যা থেকে গবেষকদের দাবি, সামুদ্রিক তাপড়া মাছ খেলে মানুষেরও ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি নিশ্চিত ভাবে কমবে।
মেদিনীপুর সিটি কলেজের প্যারামেডিক্যাল অ্যান্ড অ্যালায়েড হেলথ সায়েন্সের অধ্যাপক শ্রাবণী প্রধানের সঙ্গে এই বিভাগেরই অনন্যা দত্ত, তিতলি পাঞ্চালী, আমিনা খান, কুন্তল ঘোষ, হায়দরাবাদের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউট্রিশনের ফুড কেমিস্ট্রি অ্যান্ড টিউট্রিয়েন্ট অ্যানালিসিস বিভাগের অধ্যাপক শ্রীনিবাস রাও জারাপালা এবং বেলদা কলেজের নিউট্রিশন বিভাগের অধ্যাপক কৌশিক দাস এই গবেষণাটি করেছেন। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের অর্থানুকূল্যে গবেষণাটি হয়। সম্প্রতি যা নেচার পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছে।