গৌতম ধোনি, কৃষ্ণনগর
এভারেস্টের শীর্ষ ছোঁয়ার পরে নদিয়ার বাড়িতে ফিরলেন রুম্পা দাস। কাঠমান্ডু থেকে শিলিগুড়ি এসে সেখান থেকে বাসে চাপেন তিনি। বৃহস্পতিবার ভোরে রানাঘাটের বাড়িতে পৌঁছন রুম্পা।
অভিযানের সঙ্গী অসীমকুমার মণ্ডল আগেই নেমেছিলেন কৃষ্ণনগরে। মেয়ে দরজায় এসে পৌঁছতেই শাঁখ বাজিয়ে মেয়েকে বরণ করে ঘরে তোলেন ৭৭ বছরের মা লিলি দাস। ৮৬ বছরের বাবা অমূল্যরতন দাস আশীর্বাদ করেন মেয়েকে।
তবে এ বারের দৃশ্যটা ছিল ব্যতিক্রমী। এত দিন মাউন্টেনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ কৃষ্ণনগরের যে কোনও সফল অভিযানে কাঁধে ভারী ব্যাগ নিয়ে প্রথমে কৃষ্ণনগরে নিজেদের ক্লাবে এসে উঠতে দেখা যেত অভিযাত্রীদের।
সেখানে সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার পরে যে যাঁর বাড়ি ফিরতেন। কিন্তু এ বার ছন্দপতন হলো। কারণ একই দিনে এভারেস্ট শৃঙ্গে পৌঁছলেও ফেরার পথে মৃত্যু হয় রানাঘাটের আরও এক অভিযাত্রী সুব্রত ঘোষের।
তাই রুম্পার আনন্দও খানিক ফিকে যেন! এ দিন তিনি বলেন, ‘দু’জন একসঙ্গে নিজেদের শহর রানাঘাটে ফিরলে কী যে উচ্ছ্বাসে ভাসতাম! সেটা আর হলো না। একজন ফিরল, আর এক জন থেকে গেল পাহাড়ের কোলে। এখনও কী যে কষ্ট হচ্ছে, বলে বোঝাতে পারব না।’
এ দিন রুম্পার কথায় বারবার ফিরে আসছিলেন সুব্রত। রুম্পা বলেন, ‘আমাদের দু’জনেরই বাড়ি রানাঘাটে। এর আগে একাধিক অভিযানে ক্লাব থেকে একসঙ্গে গিয়েছি। এ বার সুব্রত আমাদের ক্লাব থেকে না-গিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এভারেস্ট অভিযানে গিয়েছিল। সুব্রতও যাচ্ছে জানতাম।
তবে দেখা হয়েছিল কাঠমান্ডু পৌঁছনোর পরে। সুব্রত, এবং বিদেশি চার অভিযাত্রী আমাদের সঙ্গে একই গ্রুপে থেকে অভিযান করবে, এটা আমরা জানতে পারি ওখানকার এজেন্সির কর্তার সঙ্গে কথা বলার পরে।
চার নম্বর ক্যাম্প থেকে আমি আর সুব্রত একই সঙ্গে সামিটের লক্ষ্যে রওনা হয়েছিলাম। পথে কোনও কারণে সুব্রত পিছিয়ে পড়েছিল। আমি এভারেস্ট ছুঁয়ে যখন নামছি, হিলারি স্টেপের কাছে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ও তখন ওপরে উঠছিল। সেটাই শেষ দেখা হবে বুঝতেও পারিনি।’ সেই হিলারি স্টেপের কাছেই পরে সুব্রতর মৃতদেহ পাওয়া যায়।
নিজের এভারেস্ট শৃঙ্গে পা দেওয়া নিয়ে রুম্পা বলেন, ‘স্বপ্নচূড়া ছুঁতে পেরেছি। ২০২১ সালে এভারেস্ট অভিযান করেও শেষ পর্যন্ত কোভিড আক্রান্ত হয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল। তারপর থেকে শুধুই ভেবেছি, কবে আবার সুযোগ আসবে।
সেই স্বপ্ন এতদিন পরে সফল হলো বলে খুবই খুশি। তবে প্রতি মুহূর্ত সুব্রতর কথা মনে পড়ছে। ওর রানাঘাটের বাড়িতে গিয়েও ওর বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করব।’
রুম্পার মা এ দিন বলেন, ‘মাকে আশীর্বাদ করে ঘরে তুলেছি ঠিকই কিন্তু এই টেনশন আর নিতে পারছি না। মেয়েকে বলেছি, আর কোনও অভিযানে যেন না যায়।’
মায়ের কথা হেসে উড়িয়ে রুম্পা বলেন, ‘বাবা–মা তো মেয়েকে বিপদ থেকে আগলে রাখতে চাইবেনই। তবে আমার ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত থাকবে!’ বাংলার বিশিষ্ট পর্বতারোহী বসন্ত সিংহরায় বলেন, ‘রুম্পা এবং সুব্রত, দু’জনেই আমার কাছে পর্বতারোহণের পাঠ নিয়ে বড় হয়েছে। রুম্পার এভারেস্টে পৌঁছনো নিয়ে আমি খুবই খুশি। শুধু শৃঙ্গ ছোঁয়াটাই নয়, বাড়ি ফেরাটাও সাফল্য।
কিন্তু ওর এই সাফল্য, এই আনন্দ উদ্যাপন করতে পারছি না, এভারেস্ট ছুঁয়েও সুব্রত বাড়ি ফিরতে পারল না-বলে। আনন্দ আর বিষাদ, দু’টোই এখন আমার মনের মধ্যে একসঙ্গে ঘুরপাক খাচ্ছে।’