হেমাভ সেনগুপ্ত, মহম্মদবাজার
আস্ত একটি জঙ্গল সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো অন্যত্র! নতুন জায়গায় সংসার পাতল ডেউচা-পাঁচামি খনি এলাকার বৃক্ষরাজি। পুনর্বাসন দেওয়া হল গাছেদের। বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকের চাঁদা মৌজার খনন এলাকা থেকে পূর্ণবয়স্ক ৯৮৪টি গাছকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো এক কিলোমিটার দূরে।
শিল্প স্থাপনে গাছ না–কেটে এমন প্রতিস্থাপন দেশের ইতিহাসে প্রথম বলেই দাবি জেলা প্রশাসনের। জেলাশাসক বিধান রায় বলেন, ‘এটা একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল। ডেউচা-পাঁচামির জন্য ভূমি দপ্তরের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলাশাসক বাবুলাল মাহাতো উদ্যানপালন বিষয়ে গবেষক। গাছ প্রতিস্থাপনের কাজ তাঁর নজরদারিতে সফল হয়েছে। আধুনিক শিল্পের জন্য এলাকার মানুষ, পরিবেশ, সংস্কৃতি কিছুই নষ্ট হতে না দিয়ে এই কাজ একটা দৃষ্টান্ত।’
প্রথম পর্যায়ে ১৮০টি গাছ প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। সেই গাছগুলি ইতিমধ্যেই নতুন পাতা গজিয়ে সবুজ হয়ে উঠেছে। বাকি গাছগুলিও লাগানো হয়ে গিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্নের প্রকল্প ডেউচা পাঁচামি কয়লা খনিপ্রকল্প। এশিয়ার সর্ববৃহৎ ও পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা ব্লক! কিন্তু সেই খনি তৈরির কাজে যাতে কোনও গাছ না কাটা পড়ে, সে কথা মাথায় রেখেই এই জঙ্গল স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
অতিরিক্ত জেলাশাসক (এলআর) বাবুলাল মাহাতো বলেন, ‘আমরা যে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে গাছগুলোকে ট্রান্সলোকেট করেছি, তাতে একটা গাছেরও ক্ষতি হয়নি। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে যাতে গাছগুলো পুনরায় বেঁচে থাকে, তার জন্য পর্যাপ্ত ওষুধ স্প্রে করা হয়েছে। আর মাস দুয়েকের মধ্যেই গাছগুলোর ফের শিকড় বের হয়েছে। এখন সবুজ পাতা গজিয়েছে। একটা পুরো জঙ্গলকে স্থানান্তরিত করা — এটা রীতিমতো রেকর্ড।’
ডেউচা পাঁচামিতে খনির কাজে যেন জঙ্গল নষ্ট না–হয়, সে দাবি তুলেছিলেন আদিবাসীরা। এলাকার বাসিন্দা মাধব বিত্তার বলেন, ‘জমি–জঙ্গলের অধিকার নিয়ে আমরা লড়াই করি। তাই আমরা চেয়েছিলাম জঙ্গল যেন নষ্ট না হয়। গাছ যেন না কাটা হয়। সেই মতো কথা রেখেছে জেলা প্রশাসন। আমরা খুশি।’
দেওয়ানগঞ্জের ধরম টুডু, রবি টুডুরা বলেন, ‘প্রশাসন যে ভাবে গাছ বাঁচানোর চেষ্টা করল, তাতে সবার ভালো হলো। আমরা গাছ কাটতে বাধা দিয়েছিলাম। এই গাছ রক্ষার দায়িত্ব আমাদের।’
প্রকল্প এলাকা: ডেউচা-পাঁচামি কয়লাখনি থেকে প্রথম পর্যায়ে ৩২৬ একর জমির নীচে কালো পাথর তোলার কাজ শুরু হয়েছে। চাঁদা মৌজায় ১৬৪ নম্বর প্লটে ১২ একর সরকারি জমিতে খননকাজ চলছে। সেই এলাকায় হাজারের বেশি পূর্ণবয়স্ক মহুয়া, পিয়াশাল, অর্জুন, শিরীষ গাছ পড়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সেই গাছগুলিকে এক কিলোমিটার দূরে একই প্লটে, একই অবস্থানে, একই দিকে প্রতিস্থাপন করা হলো।
গাছ ট্রান্সলোকেট: ডেউচা-পাঁচামি প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে কাজ শুরু হয় মাস তিনেক আগে। এলাকার মানুষকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে, ডেউচা-পাঁচামি কয়লাখনি প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে একটি গাছও নষ্ট করা হবে না। সেই মতো প্রকল্প এলাকার বাইরে এক কিলোমিটারের মধ্যে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের চিহ্নিত নির্দিষ্ট জায়গায় স্থানান্তরিত করার লক্ষ্যে গাছ তোলার কাজ শুরু হয়েছিল।
সময়কাল: গত ১৪ ফেব্রুয়ারি এই কাজ শুরু হয়। শেষ হলো ৮ মে। এই সময়ের মধ্যে ৯৮৪টি গাছ ট্রান্সলোকেট করা হয়েছে। তার মধ্যে ৭৫৫টি মহুয়া, ৭৬টি পিয়াশাল, ১৫০টি অর্জুন, দু’টি শিরীষ ও একটি বেলগাছ।
প্রতিস্থাপনের প্রস্তুতি: প্রথম পর্যায়ে গাছ চিহ্নিত করে দু’দিন আগে থেকেই গাছের গোড়ায় জল দেওয়া শুরু হয়েছিল, যাতে গোড়ার মাটি নরম হয়। গাছের মূল শিকড় অনুযায়ী প্রথমে একটি রুটবল বানানো হয়েছিল। এর পরে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে গাছের ডালপালা কেটে ছোট করে নেওয়া হয়।
তারপরেই সেখানে আইবিএ রুটিং হরমোন স্প্রে করা হয় এবং তার সঙ্গে প্যারা–হাইড্রক্সিবেনজয়িক অ্যাসিড দেওয়া হয়। গাছ তোলা হলে শিকড় থেকে ডাল — সমস্ত কাটা জায়গায় ব্লু কপার লাগানো হয়, যাতে গাছগুলোর সেই কাটা অংশ থেকে পুনরায় ডাল ও শিকড় বের হয় এবং যাতে কাটা অংশগুলো শুকিয়ে না যায়।
কী ভাবে প্রতিস্থাপন: রুটবল তৈরি হলে হাইড্রার সাহায্যে গাছগুলিকে এক কিলোমিটার দূরে স্থানান্তরিত করা হয়। এই কাজে টেকনিক্যাল এক্সপার্ট হিসাবে তিনটে টিম কাজ করেছে। প্রতি টিমে ২০ জন ছিলেন। এছাড়াও আর ৪০ জন তাঁদের সহযোগিতায় নিযুক্ত ছিলেন।
আইআইটি খড়গপুরের তত্ত্বাবধানে গাছ প্রতিস্থাপনের কাজ হয়েছে।যেখানে গাছগুলোকে পুনর্বাসন দেওয়া হচ্ছে, সেখানে আগে থেকেই গর্ত করে জল দিয়ে প্রস্তত রাখা হয়েছিল। প্রতি গাছের মাঝে ৮ মিটার দূরত্ব রাখা হয়।
সেই গর্তে উইপোকা দমন করতে প্রথমে বায়োফ্লেক্স স্প্রে করা হয়। তারপরেই ক্লোরোপাইরিফক্স দেওয়ার পরে গাছগুলোকে বসানো হয়। যাতে নতুন জায়গায় গিয়ে গাছের খাবারের অভাব না হয় তার জন্য এফওয়াইএম নামক ওষুধ দেওয়া হয়েছে। যাতে প্রয়োজন মতো খাবার গাছ সেখান থেকে পেতে পারে।
দৃষ্টান্ত কেন?
প্রথমত, পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম কোনও খনির জন্য এতগুলি গাছ ট্রান্সলোকেট বা পুনর্বাসন দেওয়া হলো। দ্বিতীয়ত, আস্ত একটি জঙ্গলকে প্রতিস্থাপন করা হলো। তৃতীয়ত, পূর্ণবয়স্ক মহুয়া গাছ এই প্রথম প্রতিস্থাপন করা হলো।