• আজও ঘানি টেনে চলছে সাউ পরিবারের দুই বলদ
    এই সময় | ২৫ মে ২০২৫
  • পুলক বেরা, তমলুক

    অতি-পরিশ্রমে, যান্ত্রিক ভাবে কোনও কাজ করলে আমরা নিজেদের কলুর বলদ বলে থাকি। রসিকজন মাত্রেই জানেন, ‘কলু’ অর্থে তেল নির্মাতাদের বোঝানো হয়। তেল মাড়াইয়ের জন্য থাকে ঘানি। তার সঙ্গে বাঁধা থাকে একটি গোরু। অন্য কোনও দিকে তাকাতে না–দেওয়ার উদ্দেশ্যে দু’চোখে থাকে ঠুলি।

    গোরুর চক্কর কাটার বলেই চলে ঘানি, বীজ থেকে বেরোয় খাঁটি তেল। যুগ বদলেছে। আধুনিক যন্ত্রের জন্য হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ঘানি তেল মাড়াইয়ের শিল্প। তমলুক শহরের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের তেলিপাড়া ছিল ঘানির তেলের জন্য বিখ্যাত।

    প্রতিটি বাড়িতে ঘুরত গরুর ঘানি। সর্বক্ষণই নাকে আসত খাঁটি সর্ষে, ‍নারকেল বা তিলের তেলের সুবাস। এখন সে দৃশ্যের ঠাঁই শুধুমাত্র স্মৃতির পাতায়। তবে, এখনও এই রীতিকে আঁকড়ে রেখেছে সাউ পরিবার।

    পরিবারের সদস্যরা জানান, রাজস্থান থেকে ১১০ টাকা করে কুইন্ট্যাল সরষে নিয়ে আসা হয়। সারাদিন ধরে প্রায় ১০ কেজি তেল তৈরি হয়। ১০ কেজি তেলের জন্য লাগে ৩৫ কেজি সর্ষে। বর্তমানে বাজারে এই তেলের দর কেজিপ্রতি প্রায় ৫৫০ টাকা। এক শতকেরও বেশি সময় ধরে বংশ পরম্পরায় এই ব্যবসা চালাচ্ছে সাউ পরিবার।

    সাউ বাড়ির উঠোনে আজও সকালবেলায় গরুর ঘানি ঘোরে। সে বাড়িতে ঢুকে চোখে পড়ে কাঠের ঘানি, হাতে করে সর্ষে গাঁথার দৃশ্য; নাকে আসে ঝাঁজালো তেলের মৃদু গন্ধ— মনে হয়, সময় যেন থমকে গিয়েছে এ বাড়ির উঠোনে।

    শুধু তমলুক নয়, হলদিয়া, মহিষাদল, পাঁশকুড়া, নন্দকুমার, এমনকী হাওড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর থেকেও বহু মানুষ এই তেল কিনতে আসেন।

    তেলিপাড়ার প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, ‘আগে প্রতিটা বাড়িতেই ঘানি চলত। আমরা নিজেরাই তেল বানিয়ে খেতাম। সেই তেলের স্বাদ আর গুণ আজকের মেশিনে তৈরি তেলে মেলে না।’

    তেল নিতে আসা অমল বেরা ও দেবাশীষ মাজীর বক্তব্য, ‘আমাদের বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে এই তেল যায়। এখন এক এক করে সবাই ব্যবসা গোটাচ্ছেন। আগামীতে এই তেল কোথায় মিলবে, সে নিয়ে মনে প্রশ্ন রয়েছে।’

    বহু চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদ আজও ঘানি তেলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কম তাপমাত্রায় এই তেল তৈরি হয় বলে পুষ্টিগুণ রয়ে যায়। নানা ব্যথা, সর্দি–কাশির গ্রামীণ চিকিৎসায় আজও এই তেল ব্যবহৃত হয়।

    কারণ সন্ধান করতে গিয়ে অভিজ্ঞদের মতামত, ঘানি চালাতে পরিশ্রম লাগে, গরু পোষারও খরচ রয়েছে। অনেকেই আর এই ঝামেলা নিতে চান না। এ ছাড়া মেশিনে তৈরি তেল দ্রুত ও বেশি পরিমাণে উৎপাদিত হয়। তাই, বাজার ‘ধরতে’ বেশি সময় লাগে না। ঘানি তেলে যেমন বেশি সময় লাগে, তেমনই দামও বেশ বেশিই।

    আধুনিক জীবনের ছোঁয়ায় আবিষ্ট বর্তমান প্রজন্ম তেলিপাড়ার এই ঘানির তেলের ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও মাত্র একটি পরিবার যে ভাবে ‍নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, তা প্রশংসনীয়। একটি পেশা শুধু নয়, তাঁদের হাত ধরে বেঁচে রয়েছে এক ইতিহাস।

    সাউ পরিবারের সদস্য রাজিব বলছেন, ‘ব্যবসা চালিয়ে যেতে কষ্ট হয় ঠিকই, কিন্তু মানুষ যখন এসে বলে, ‘এই তেল না হলে রান্নার স্বাদই আসে না’ বা ‘এই তেল না–থাকলে ছোট বাচ্চাদের আমরা কী মাখাব,’ তখন সেই ভালোবাসাই আমাদের এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে।’

    আজকের যান্ত্রিক যুগে তেলিপাড়ার এই ঘানি যেন সময়ের কাছে হার না–মানা এক সংগ্রামী সৈনিক। সমাজ, সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের উচিত এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করা— না হলে আগামী কয়েক বছর পরে হয়তো আর কোনও শিশুই জানবে না ‘ঘানি’ কাকে বলে।

  • Link to this news (এই সময়)