• মন্দির ও ইদগাহ মিলে সম্প্রীতির নিদর্শন গড়বেতার রঘুনাথ বাড়ি
    এই সময় | ২৫ মে ২০২৫
  • সুভাষ চট্টোপাধ্যায়

    অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পশ্চিমে বগড়ী পরগনা। তার উল্লেখ রয়েছে আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’-তেও। এই বগড়ী পরগনাই বর্তমানে বৃহত্তর গড়বেতা-মহল্লা। তার পশ্চিম অংশে রয়েছে বগড়ীর দোল মন্দির। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে শিলাবতী নদী।

    সেই শিলাবতীরই সৈকতভূমি সংলগ্ন এলাকায় তৈরি হয়েছিল এক রামমন্দির। সময়কাল জানা যায় না, কিন্তু বহু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও তা রয়ে গিয়েছে। লোকমুখে তা ‘রঘুনাথ বাড়ি’ নামেই পরিচিত।

    ঐতিহাসিক ঐতিহ্যেই মন্দিরটি আজও প্রাসঙ্গিক। কারণ, মুসলমান জনপদ সংলগ্ন এই রামমন্দিরের গা বেয়ে রয়েছে একটি ইদগাহ​্। জনশ্রুতি রয়েছে, সম্রাট আকবরের আমলে নাকি একখানি মসজিদও ছিল এখানে। পরবর্তী কখনও বন্যায় তা নদীগর্ভ বিলীন হয়ে যায়। বগড়ীর বিখ্যাত দোলমেলার শুরুও নাকি ওই সময়েই।

    রামমন্দির ও ইদগাহ​্ বা লুপ্ত মসজিদের এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ভারতীয় সমাজ জীবন ও ধর্ম সমন্বয়ের এক গৌরবময় নিদর্শন। বর্তমানে রঘুনাথ বাড়িতে রাম-সীতার মূর্তি আর নেই। বেশ কিছু আগে ধাতুর সীতা বিগ্রহ চুরি হয়ে যায়।

    রামমূর্তিটি এখনও পুজো পাচ্ছে কাছের শুনিয়াকোন গ্রামের চক্রবর্তী পরিবারে। এই চক্রবর্তী পরিবারই ছিল বংশ পরম্পরায় রঘুনাথ বাড়ির পূজারী। রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও রামবিগ্রহ না থাকার কারণেই মন্দিরটি এখন দেবতাশূন্য। তবে দোলের সময়ে এখনও দেখা মেলে হনুমান ও লক্ষ্মণের।

    প্রাচীন এই মন্দির কোন হিন্দু রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা আজও জানা যায়নি। তবে নবরত্ন আদলের ছোটবড় সুদৃশ্য পাথরের নির্মাণের সঙ্গে পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির বা ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দিরের স্থাপত্য ও নির্মাণরীতির মিল পাওয়া যায়।

    মন্দিরের পাশেই রয়েছে ছোট একটি পাথরের মন্দির। তবে, তা আজ ভগ্নদশায়। এককালে এই মন্দিরে সাবিত্রী সত্যবানের মূর্তি ছিল বলে জানা যায়। শিলাবতী নদীতে স্নান করে হিন্দু রমণীরা এখানে শাঁখা-সিঁদুর পরতেন। কেউ কেউ বলেন, এখানে সতীর ঘাটও ছিল।

    মৈথুন ভাস্কর্যের কিছু চিহ্নও মেলে এই মন্দিরে। বারবার চুনকামের কাজের ফলে মৈথুন মূর্তিগুলি এখন রঙের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। মুখ লুকিয়েছে মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকালও। তবে মৈথুন ভাস্কর্যের চিহ্ন, সাবিত্রী–সত্যবান মন্দিরের অক্ষত খিলান, মূল মন্দিরের উপাদান ও গঠনরীতি দেখে কিছু ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল গুপ্ত যুগে।

    এই এলাকার অন্যান্য প্রাচীন মন্দিরগুলিতে আর্যাবর্ত বা উত্তর ভারতের শাসকদের ছাপও বর্তমান। রঘুনাথ বাড়িও তার ব্যতিক্রম নয়। ‘রাম’ নামের বদলে ‘রঘুনাথ’ নামটি উত্তর ভারতে প্রচলিত। তাই, এর প্রতিষ্ঠাতা সংক্রান্ত প্রশ্নে গুপ্ত রাজবংশের নাম জড়ালে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

    রঘুনাথ বাড়ির আচার রীতিই মন্দিরটির প্রাচীনত্ব প্রমাণের দলিল। প্রচলিত আছে, বগড়ীর রাজা গজপতি সিংহের সময়ে কৃষ্ণরায়জির দোলযাত্রা উৎসব শুরু হয়। তখন দিল্লির মসনদে সম্রাট আকবর। পরে বগড়ীর আচ বংশের রাজাদের ঠাকুরকে দেওয়া প্রচুর জমিজমা বিক্রি করে দিয়েছিলেন জনৈক প্রতারক রঘুনাথ।

    অনেকে মনে করেন, জমিদারদের রেকর্ডেও ভুল থাকতে পারে। কিছু দিন আগে পর্যন্ত এই মন্দির ছিল সংস্কারহীন, ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ। তবে বর্তমানে অছি-পরিষদ বা ট্রাস্টি সেই সব ভ্রান্তি সংশোধন করছেন। মন্দিরটিরও প্রায় প্রায় সম্পূর্ণ। আকর্ষণীয় এবং সংরক্ষিতও। এই প্রাচীন মন্দিরের প্রাচীনত্ব ও ঐতিহ্য রক্ষায় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই যত্নবান ও সচেষ্ট। তা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অন্যতম নিদর্শনও বটে।

    (লেখক পেশায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

  • Link to this news (এই সময়)