• যুগের সঙ্গে হারিয়ে যাবে কাঁসা শিল্প? উত্তর খুঁজছে বাঁকুড়ার কেঞ্জাকুড়া
    এই সময় | ২৬ মে ২০২৫
  • হাতুড়ি আর হাম্বরের শব্দে সকলের ঘুম ভাঙে গ্রামে। তামা ও টিনের সংমিশ্রণে তৈরি এক মিশ্র ধাতুই সেই গ্রামের সম্বল। বাঁকুড়া শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে দ্বারকেশ্বর নদের তীরে কেঞ্জাকুড়া গ্রাম নাম কুড়িয়েছে কাঁসার বাসনের জন্য। বিয়ে হোক বা মুখেভাত, বাংলার ঘরে ঘরে অনুষ্ঠান বাড়ির উপহারের তালিকায় একসময় শীর্ষে থাকত কাঁসার বাসন। সেই বাসন তৈরি করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন এই গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবার। অ্যালুমিনিয়াম বা সিরামিকের যুগে কাঁসার তৈরি বাসনের ব্যবহার বর্তমানে শৌখিনতা। নিত্যদিনই কমেছে ব্যবহার। কমছে কাঁসা শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর রোজগারও। 

    কেঞ্জাকুড়া গ্রামে এক সময় প্রায় চারশো কাঁসার বাসন তৈরির কারখানা ছিল। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। কেবলমাত্র কর্মকার সম্প্রদায়ের মানুষই নয়, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে যুক্ত ছিল এই কুটির শিল্পের সঙ্গে। বর্তমানে সেই সংখ্যাটা অনেকটাই কমে এসেছে। এখানকার কাঁসার তৈরি জিনিসপত্র রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে পাড়ি দিত ভিন রাজ্যে। পিতলের নানা জিনিস ব্যবহারের কিছুটা চল থাকলেও কাঁসার জিনিস বা বাসনপত্র ব্যবহার অনেকটাই কমেছে গৃহস্থালীতে বলে দাবি শিল্পীদের। 

    শিল্পীরা জানাচ্ছেন, মূলত দুটি কারণে এই শিল্পে কমছে সংস্থান। 

    ১. বর্তমানে কাঁচামালের অপর্যাপ্ত যোগান এবং অত্যাধিক দাম বৃদ্ধির কারণে মুখ ফেরাতে হচ্ছে অনেককেই। 

    ২.উৎপাদিত দ্রব্যের চাহিদা কম থাকায় ধুঁকছে কাঁসা পিতল শিল্প। কেঞ্জাকুড়া গ্রামের পাশাপাশি বাঁকুড়ার একাধিক গ্রামে রমরমিয়ে চলত কাঁসা পিতলের জিনিস তৈরির কাজ। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই সেই কাজ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন।

    বাসন প্রস্তুতকারকরা জানাচ্ছেন, কাঁসা ও কাঁসার বাসন তৈরির প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ। ৭:২ ভাগে তামা ও টিন থেকে কাঁসা তৈরি হয়। তাছাড়া পুরোনো ভেঙে যাওয়া কাঁসার বাসন থেকেও নতুন করে বাসন তৈরি করা হয়। প্রথমে সেটিকে গলিয়ে ফেলার পর তা থেকে ‘বাট’ তৈরি হয়। এর পরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যবহার যোগ্য বাসনের রূপ নেয়।

    প্রায় ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই শিল্পকে আঁকড়ে জীবিকা নির্বাহ করেন এই গ্রামের বাসিন্দা প্রদীপ চন্দ। তিনিও আজ এই শিল্পকে নিয়ে হতাশ। তাঁর কথায়, ‘পরিস্থিতি খুব খারাপ। এখন বেঁচে থাকার জন্য এই কাজ করা। সে ভাবে আর রোজগার নেই। আগে যেখানে রোজ কাজ হতো, এখন তা সপ্তাহে এক-দু’দিনে দাঁড়িয়েছে। অন্য কোনও কাজ না জানায় এখনও কাঁসা শিল্পকেই আঁকড়ে থাকি। আমার সন্তানেরা এই কাজ করতে চায় না।’

    আরেক শিল্পী বাপি বাউরি বলেন, ‘আমরা মালিকের অধীনে কাজ করি। সারা দিন পরিশ্রম করে হাতে চারশো থেকে সাড়ে চারশো টাকা পাই। সপ্তাহের সব দিন কাজ পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা হয় না।’

    পুরুষদের পাশাপাশি গ্রামের মহিলারাও এই কাজে সরাসরি যুক্ত রয়েছেন। মূলত কাঁসার তৈরি জিনিসপত্র পালিশের কাজ করেন। তাঁদেরই একজন রিঙ্কু কর্মকার বলেন, ‘বর্তমানে কাঁচামালের আমদানি নেই। জিনিসের চাহিদাও কমেছে। সব মিলিয়ে অবস্থা বেশ খারাপ। এখন সারা দিন কাজ করে তিন থেকে সাড়ে তিনশো টাকা রোজগার করি।’ গত কয়েক বছরে রোজগার অনেকটাই কমেছে বলে দাবি তাঁদের।

    কেঞ্জাকুড়া কাঁসা পিতল বাসন উন্নয়ন সমিতির সঞ্চালক সুজয় চন্দ জানালেন, আগে গ্রামে ৩৮২টি ইউনিট ছিল, প্রতিটি ইউনিটে গড়ে ন’জন কাজ করতেন। বর্তমানে তা ৬০ থেকে ৭০টিতে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও বাঁকুড়া জেলায় আগে ৮৪টি গ্রামে এই শিল্প ছিল, এখন তা এক দু’টি গ্রামে টিকে আছে। ফলে এই শিল্প ‘মৃতপ্রায়’ বলা চলে। উন্নয়ন সমিতির সভাপতি বিদ্যুৎ কর্মকারের কথায়, ‘ঐতিহ্যবাহী কাঁসা শিল্প আজ ধুঁকছে। শিল্পীদের হাতে কাজ নেই। এই অবস্থায় অনেকেই বিকল্প পেশার দিকে ঝুঁকছেন। ফলে এই শিল্পের ভবিষ্যতের কথা ভেবে খানিক মন খারাপ তো হয়ই।’

    প্রাচীন এই শিল্পের গ্রাফ ক্রমশ নিম্নমুখী। ধীরে ধীরে কি হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার এই প্রচলিত কুটির শিল্প? উত্তর খুঁজছে কেঞ্জাকুড়া।

    তথ্য সহায়তা: মনোজ কর্মকার

  • Link to this news (এই সময়)