দীর্ঘদিনের দাবি, আড়ষার দেউলঘাটার মন্দির সংরক্ষণ ও সংস্কারের কাজ শুরু
বর্তমান | ২৬ মে ২০২৫
নিজস্ব প্রতিনিধি, পুরুলিয়া: সংস্কারের দাবি উঠছিল দীর্ঘদিন ধরেই। অবশেষে সেই দাবি মেনে পুরুলিয়ার আড়ষার দেউলঘাটার মন্দিরগুলির সংরক্ষণ ও সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের তত্ত্বাবধানে সংস্কারের কাজ হচ্ছে। প্রায় আড়াই কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। বরাদ্দকৃত সেই অর্থে ধ্বংস হতে বসা তিনটি মন্দিরের সংস্কারের কাজ হচ্ছে। সংস্কারের কাজ করছে পূর্তদপ্তর। তদারকির দায়িত্বে রয়েছে জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর ও ব্লক প্রশাসন।
আড়ষার বিডিও গোপাল সরকার বলেন, ‘টাকা বরাদ্দ হয়েছে। ইতিমধ্যে কাজ চলছে।’ জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী বলেন, কোনওরকম বিচ্যুতি না ঘটিয়েই মন্দিরগুলি সংস্কার করা হবে। একাধিক বিশেষজ্ঞ দল এসে মন্দির খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছে। কীভাবে সংস্কার হবে, তার নকশা তৈরি করেছেন। পুরো বিষয়টি আমরা নজরে রাখছি।
অযোধ্যা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরেই অবস্থিত দেউলঘাটার প্রাকৃতিক পরিবেশ মন মুগ্ধকর। একসময় পর্যটকদের আনাগোনা ছিল। কিন্তু, গত কয়েক বছর ধরেই ভরা মরশুমেও পর্যটকশূন্য থাকে দেউলঘাটা। এর কারণ হিসেবে প্রশাসনের উদাসীনতাকেই দায়ী করছিল স্থানীয়দের একাংশ। দাবি উঠছিল মন্দির সংস্কারেরও। অবশেষে সেই দাবি পূরণ হওয়ায় খুশি স্থানীয় বাসিন্দারাও।
আড়ষা ও জয়পুর ব্লকের সীমানা দেউলঘাটায় কংসাবতী নদীর তীরেই দু’টি সুপ্রাচীন মন্দির জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। আরও একটি মন্দির ছিল। যদিও সংরক্ষণের অভাবে প্রায় দু’দশক আগে সেটি ধ্বংস হয়ে যায়। আশেপাশে ছড়িয়ে রয়েছে ধ্বংসস্তূপ। মন্দিরের গায়ে রয়েছে অসাধারণ পাথরের ভাস্কর্য। মন্দিরের দরজা ত্রিভুজাকৃতি। মন্দিরে অধিষ্ঠিত রয়েছেন কালো পাথরে খোদিত দেবী দশভুজা। দেবীমূর্তির মাথার উপর রয়েছে চক্র স্তম্ভ। পায়ের তলায় আছে পরিদের মূর্তি। মায়ের দু’পাশে রয়েছে অষ্ট মাতৃকা রূপ। তবে প্রচলিত দুর্গা প্রতিমায় যেমন দেবীর ডান পা সিংহের উপর ও বাঁ পা মহিষের উপর দেখা যায়, এই মূর্তির ক্ষেত্রে ঠিক তার বিপরীত। দেবীর সঙ্গে নেই তাঁর সন্তানরা। এই মন্দিরে পাথরে খোদিত দশভুজার মূর্তি ছাড়াও আরও অনেক দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। যেমন পদ্মের উপর দাঁড়িয়ে থাকা চার ফুট উচ্চতার চতুর্ভুজা দেবীমূর্তি, সিংহের পীঠে দণ্ডায়মান চতুর্ভুজা দেবীমূর্তি, আট হাতের রণচণ্ডী দেবীমূর্তি, তিন ফুট উচ্চতার গণেশ মূর্তি, ভগ্ন ধ্যানমগ্ন মূর্তি, শিবলিঙ্গ ইত্যাদি। বহুমূর্তি চুরিও গিয়েছে।
এই মন্দির কারা প্রতিষ্ঠা করেছিল, এসব মূর্তিই বা কত বছর পুরাতন সে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, দশভুজা মূর্তিটি আজ থেকে দু’আড়াই হাজারেরও বেশি পুরাতন বৌদ্ধ যুগের। মন্দিরের গঠন, মূর্তির কারুকাজে রয়েছে বৌদ্ধ সংস্কৃতির ছাপ। আবার ভিন্নমতে, এসবই জৈন সংস্কৃতির। পরে ব্রাহ্মণদের সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এনিয়ে বিতর্ক চলতেই থাকে। তবে, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় দেউলঘাটা নামটি এসেছে দু’টি শব্দ ‘দেউল’ অর্থাৎ মন্দির এবং ‘ঘাট’ অর্থাৎ কাঁসাই নদীঘাট থেকে। জনশ্রুতি, প্রাচীন সময়ে তাম্রলিপ্তের (বর্তমান তমলুক) বণিকরা ঝাড়খণ্ডে যেতেন বাণিজ্য করতে। তখন কংসাবতী নদীর ঘাটে নৌকা রেখে তাঁরা এই মন্দিরে পুজো দিতেন। তবে, মন্দিরগুলি সংরক্ষণের অভাবে ধুঁকতে বসেছিল। তার সংস্কার কাজ শুরু হওয়ায় খুশি বাসিন্দারা।