• ছুটি শেষ, কুমোরের চাকা ফের ঘুরছে পাঁচমুড়ায়
    এই সময় | ২৬ মে ২০২৫
  • দুর্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বাঁকুড়া

    শেষ হলো এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বিশ্রামের পালা। রবিবার থেকে আবার কুমোরের চাকা ঘুরতে শুরু করল পাঁচমুড়ায়। শনিবার প্রথা মেনে হয় চাকা পুজো। প্রতি বছরের মতো এ বারও উৎসবমুখর হয়ে উঠল বাঁকুড়ার এই টেরাকোটার গ্রাম।

    বাঁকুড়া বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে টেরাকোটার শিল্প। তার পীঠস্থান জেলার তালড্যাংরা ব্লকের পাঁচমুড়া। এ গ্রামের কুমোরপাড়ার প্রায় ৯০টি পরিবার যুক্ত পোড়ামাটির শিল্পের সঙ্গে।

    বিদেশেও রয়েছে এখানকার টেরাকোটার কদর। গ্রামের শিল্পীদের ঝুলিতে রয়েছে নানা পুরস্কার ও সম্মান। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিল্পে আধুনিকতার ছোঁয়াও লেগেছে।

    সেই টেরাকোটার গ্রামে রয়েছে এক প্রাচীন রীতি। বংশ পরম্পরায় তা মানে শিল্পী পরিবারগুলি। কী সেই রীতি? শিল্পীরা জানালেন, প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তির দু’দিন আগে কুমোরের চাকার মাঝখানে কাঁচা মাটি দিয়ে তৈরি করা হয় শিবলিঙ্গ।

    তার মধ্যে শেষ করে ফেলতে হয় মাটির কাজ। পয়লা বৈশাখ থেকে বন্ধ হয়ে যায় সমস্ত কাজকর্ম। এক মাসেরও বেশি সময় থেমে থাকে কুমোরের চাকা। ওই সময়ে চোখে পড়ে না শিল্পীদের ব্যস্ততা।

    বৈশাখের পরে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরুতে আবার রীতি মেনে কুমোরপাড়ায় চাকা ঘোরা শুরু হয় শিল্পীদের হাতে। পাঁচমুড়ার টেরাকোটা শিল্পী ব্রজনাথ কুম্ভকার বলছিলেন, ‘পয়লা বৈশাখ থেকে কাজ বন্ধ থাকে। তার পরে জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম বিজোড় শনিবারে কুমোরপাড়ার প্রত্যেক শিল্পীর বাড়িতে হয় চাকা পুজো।

    পুজোর পরে চাকার মাঝখানে থাকা শিবলিঙ্গকে জলে ভাসানো হয়। সারা বছর কাজের জন্য শিল্পীরা যেখান থেকে মাটি সংগ্রহ করেন, সেই জায়গা থেকে প্রত্যেকে একটু হলেও মাটি সংগ্রহ করে এনে বাড়িতে কর্মস্থানে মাটি রাখার নির্দিষ্ট জায়গায় রাখেন। পরের দিন থেকে যথারীতি মাটি সংগ্রহ ও শিল্পসামগ্রী তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায় গ্রামে। চলে সারা বছর।’

    প্রথা মেনে ভক্তি সহকারে চাকা পুজো হয় পাঁচমুড়ায় শিল্পীদের বাড়িতে। পুরুষদের পাশাপাশি পুজোর আয়োজনে হাত লাগান বাড়ির মহিলারাও। শিল্পীদের বাড়িতে গিয়ে চাকা পুজো সারেন পুরোহিত। চাকার ঠিক মাঝখানে তৈরি করা শিবলিঙ্গকে শিল্পের দেবতা নটরাজ ও ঐশ্বর্যের দেবী মহালক্ষ্মী জ্ঞানে পুজো করা হয়।

    পাঁচমুড়া মৃৎশিল্পী সমবায় সমিতির সম্পাদক সুদর্শন কুম্ভকার বললেন, ‘ফল, মিষ্টির সঙ্গে পুজোয় দেওয়া হয় হলুদ মুড়ি, মুড়কি ও বিভিন্ন ধরনের কলাই। এ ছাড়া পুজোর জন্য বিশেষ ভাবে দেওয়া হয় পদ্মফুল।’

    চাকা পুজো ঘিরে যেন উৎসবে মেতে ওঠে পাঁচমুড়া। আত্মীয়, বন্ধুরাও জড়ো হন শিল্পীদের বাড়িতে। গ্রামের এক টেরাকোটা শিল্পী ভূতনাথ কুম্ভকার বললেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষদের আমল থেকেই এই নিয়ম চলে আসছে। প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ থেকে মাটির কাজ বন্ধ রাখা হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম বিজোড় শনিবারে চাকা পুজো করে ফের আমরা কাজ শুরু করি।’

    পূর্বজদের আমল থেকে চলে আসা এই নিয়ম নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের ধারণা, বৈশাখে কাটফাটা গরম থাকে বাঁকুড়ায়। সেই গরমে কাঁচা মাটির তৈরি সামগ্রী আগুনে পোড়ানোর আগেই ফেটে যায়।

    অত্যধিক গরমে কাজ করতে গিয়ে শিল্পীরাও অসুস্থ হয়ে পড়েন। গরমে জলসঙ্কটও দেখা দেয়। সম্ভবত সে কারণেই বছরের প্রথম মাসে কুমোরের চাকা বন্ধ রাখার এই নিয়ম চলে আসছে। পূজার্চনা শেষ। কুমোরপাড়ায় আবার শোনা যাবে চাকা ঘোরার শব্দ!

  • Link to this news (এই সময়)