• অফবিটের চাপে পাগাড়ে বাড়ছে হোম-স্টে, ঘনিয়ে আসছে বিপদ
    এই সময় | ২৭ মে ২০২৫
  • প্যালারাম-হাবুল-ক্যাবলাদের সঙ্গে টেনিদা জঙ্গলভ্রমণে গিয়েছিলেন। শহুরে সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র অসীম-সঞ্জয়-হরি এবং শেখরও পাড়ি দিয়েছিলেন জঙ্গলে। একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই ছাড়া বলতে গেলে তাঁদের আর তেমন চাহিদা ছিল না।

    এই সে দিন পর্যন্ত মানুষ জল-জঙ্গল-পাহাড়ে বেড়াতে যেতেই পছন্দ করতেন। জল-জঙ্গল বলতে বাংলার এবং পড়শি ঝাড়খণ্ডের একাধিক জায়গা ছিল পছন্দের তালিকায়। আর পাহাড় বলতে উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ কিংবা হিমাচলপ্রদেশ, পরিস্থিতি ভালো থাকলে কাশ্মীর। তবে পছন্দের তালিকায় পয়লা নম্বরে ছিল ঘরের দোরের দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং কিংবা মিরিক।

    কিন্তু গত এক-দেড় দশকে পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়ার হাল–হকিকৎ বদলে গিয়েছে বিলকুল। এখন চাহিদায় পয়লা নম্বরে অফবিট ডেস্টিনেশন। যার শুরু হয়েছিল কালিম্পংয়ের পাহাড়ি গ্রাম ইচ্ছেগাঁওকে কেন্দ্র করে। তার পরে ‘ওল্ড সিল্ক-রুট’-এ কালিম্পংয়ের সঙ্গে সিকিমের বেশ কিছু গ্রাম।

    তার পরে খাতা খুলেছে একের পর এক ‘ভার্জিন ট্যুরিস্ট স্পট’। সবই পাহাড়ি গ্রাম। কিন্তু বেড়াতে গেলে থাকা-খাওয়ার কী হবে? মুশকিল আসান হয়ে আবির্ভূত হয় হোম-স্টে। পাহাড়ি কোনও বাড়িতে সেই পরিবারের সঙ্গে তাঁদের এক জন হয়ে থাকা-খাবার ব্যবস্থা।

    কিন্তু তাতে পর্যটকদের আশ মিটবে কেন! তাঁদের চাই শহুরে স্বাচ্ছন্দ্য। তাই সেই হোম-স্টে’র কনসেপ্টও বদলেছে। শহুরে পর্যটকদের চাহিদা মেটাতে পুরোদস্তুর হোটেলের সুযোগ-সুবিধাওয়ালা ঠিকানার উদয় হয়েছে, নাম যদিও সেই হোম-স্টে!

    গত পাঁচ বছরে দার্জিলিং এবং কালিম্পং জেলার প্রায় সব গ্রামেই শুরু হয়েছে এমন হোম-স্টে ব্যবসা। মাথা তুলছে একের পর এক হোম-স্টে। পাহাড়ি পরিবারের সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতা আর নেই বললেই চলে।

    বছরকয়েক আগে মিরিকে ধসের কথা এখনও অনেকের মনে আছে। অসংখ্য বাড়ি-ঘর নষ্ট হয়েছিল। প্রবল বৃষ্টির সঙ্গেই ধসের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ। বর্তমানে উত্তরের পাহাড়ের গ্রামগুলিতে সেই নির্মাণকাজই চলছে বিরামহীন ভাবে।

    দাওয়াইপানি দার্জিলিংয়ের ছোট্ট গ্রাম। এখানকার জলে ওষধি-গুণ রয়েছে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু নৈসর্গিক দৃশ্যের তুলনা নেই। কাঞ্চনজঙ্ঘার পুরো রেঞ্জ তো বটেই, সিকিমের রাবাংলা-নামচিও পরিষ্কার দেখা যায়। রাতের দৃশ্য অবর্ণনীয়।

    আর এই মোহেই বাড়ছে পর্যটকের সংখ্যা, বাড়ছে হোম-স্টে। বর্তমানে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, কারও একটা কাঠের বাড়ি থাকলেও বিনিয়োগকারীর অভাব নেই। সেই বাড়ি মাসছয়েকের মধ্যেই বদলে যাচ্ছে কংক্রিটের হোম-স্টে’তে। হোম-স্টে চালাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা, লভ্যাংশ আধাআধি ভাগ হচ্ছে।

    এর বাইরেও বাড়ি লিজ় নিয়ে, জমি লিজ় নিয়ে হোম-স্টে হচ্ছে। বেশির ভাগই চালাচ্ছেন বহিরাগতরা। দার্জিলিংয়ের পাহাড়ের এক গ্রামের বাসিন্দা দাওয়া নোরবু শেরপা বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে মেরে-কেটে খানসাতেক হোম-স্টে ছিল। এখন একশোর বেশি! রোজই পাহাড়ে কোপ পড়ছে, গাছ কাটা পড়ছে।

    পাহাড়ের যে বাস্তুতন্ত্র, নষ্ট হচ্ছে। ধস নামলে সবাই বিপদে পড়ব।’ আর এক বাসিন্দা নিংমা তামাং বলেন, ‘আসলে হোম-স্টে তৈরির জন্য সরকারি কোনও বিধিনিষেধ নেই। যেমন খুশি নির্মাণ হচ্ছে। অবিলম্বে নিয়ম তৈরি না হলে চরম বিপর্যয় আর দূরে নয়।’

    পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত দার্জিলিং পাহাড়ে এমন নির্মাণকাজ নিয়ে জাতীয় পরিবেশ আদালতে মামলা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আগে এটা দার্জিলিং-কালিম্পংয়ের মতো শহরের সমস্যা ছিল। এখন শুধু দাওয়াইপানি নয়, কালিম্পং-দার্জিলিংয়ের প্রায় সব গ্রামেরই সমস্যা। অবিলম্বে এটা নিয়ে সরকারের ভাবা উচিত।’

  • Link to this news (এই সময়)