এক সময় গাঁয়েগঞ্জে, এমনকী মফফস্বলেও বহুরূপীদের রমরমা ছিল। গ্রামীণ বাংলার এ এক লোকশিল্প। শিল্পী কখনও দেবতা বা দেবী সেজে, কখনও ডাকাত সেজে, কখনও পশু সেজে, ঘুরে ঘুরে মনোরঞ্জন করতেন। সঙ্গে থাকত ঝোলা। বহুরূপীকে খুশি করতে কেউ দিতেন এক আনা, কেউ দু’আনা। কেউ শিল্পীর ঝোলায় ভরে দিতে দিতেন এক মুঠো চাল বা কাঁচা সবজি। এখনও চৈত্র মাসে বাংলার নানা গ্রামে বহুরূপীদের দেখা মেলে। এমনও শোনা যায়, বহুরূপীদের ছদ্মবেশ ধরার দক্ষতার কারণে, এক সময় রাজারা চর হিসাবেও তাঁদের কাজে লাগাতেন। সময় বদলেছে। বদলেছে বহুরূপীদের জীবনযাত্রাও। ডিজিটাল যুগে এখন আর তেমন দেখাই যায় না এই লোকশিল্পীদের।
এক সময় ভর দুপুরে হঠাৎই গ্রামের পথে শোনা যেত জলদগম্ভীর হাঁক, ‘আমি বাংলার রঘুডাকাত, সব ব্যাটাকে করব কুপোকাত।’ যেমন সাজ, তেমনই হাড়হিম অট্টহাসি। ছোট ছেলেমেয়েদের সে কী ভয়! কেউ মায়ের পিছনে গিয়ে লুকোয়, কেউ আবার মুখ ঢাকে আঁচলে। আবার কখনও শোনা যেত, ‘হাউমাউ খাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ। ধরে ধরে ঘাড় মটকে খাঁউ।’ উঁকি মারতেই দেখা মিলত বিকট দর্শন রাক্ষসীর। রাস্তায় কচিকাঁচারা বহুরূপীদের দেখতে পেলেই, ভয়ে দে দৌড়। কিন্তু এখন তাঁদের দেখা পাওয়া তো দূরের ব্যাপার, বইয়ের পাতাতেও বহুরূপীদের কথা মেলে না।
বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে ওতোপ্রতো ভাবে জড়িয়ে তো ছিলই, সাহিত্যেও এক সময় জায়গা করে নিয়েছেন বহুরূপীরা। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘ছিনাথ বহুরূপী’কে নিশ্চয়ই মনে আছে? সম্প্রতি বহুরূপীদের জীবন নিয়ে একটা আস্ত সিনেমাও তৈরি হয়েছে বাংলায়।
লোকশিল্প গবেষকদের মতে, বহু এবং রূপ শব্দ মিলে বহুরূপী শব্দের উৎপত্তি। আক্ষরিক অর্থেই বহু অর্থাৎ রকমারি রূপ দেখিয়ে মানুষজনকে আনন্দ দিতেন তাঁরা। তখন বছরে দু'- এক বার টানা সাত-আটদিন রকমারি সাজ দেখিয়ে যেতেন তাঁরা। প্রথম দিন তাঁদের কাঁখে কলসি নিয়ে গোয়ালিনী কিংবা কাঁধে বাঁক ঝুলিয়ে রাখাল রাজার বেশে আসতে দেখা যেত। কালী, রাম, রাবণ, হনুমান, রঘু ডাকাত, তারকা বা হিড়িম্বা রাক্ষসী, নানা রকমের সাজ। সে সব সাজের সঙ্গে মানানসই কথা কিংবা গান শোনা যেত তাঁদের গলায়।
পালা শেষে যে দিন ফিরতেন, ফের গোয়ালিনী কিংবা রাখালরাজার বেশ ধরতেন। সঙ্গে থাকত ধামা, ঝোলা। বাড়িতে বাড়িতে সেই ধামা, ঝোলা পেতে গলা ছাড়তেন, ‘মাগো, এতদিন তোমাদের ননী-দুধ দিয়ে গিয়েছি। আজ তাড়াতাড়ি দামটা দিয়ে আমাকে বিদেয় করো মা। আরও পাঁচ বাড়ি ঘুরতে হবে।’ বাড়ির গিন্নিরা হাসিমুখে চাল, ডাল, তরকারি ভর্তি করে দিতেন ঝোলায়। কেউ কেউ নগদ টাকাও দিতেন, ঘরে থাকা পুরোনো পোশাক দিয়ে দিতেন শিল্পীদের বাড়ির বাচ্চা কিংবা মহিলাদের জন্য।
এখন গাঁয়েগঞ্জে খুবই কম বহুরূপীদের দেখা যায়। তবে একটানা বহুরূপী সেজে কাউকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় না। হঠাৎ করে একদিন এসে যে কোনও একটি সাজ দেখিয়ে যাওয়ার চল হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হনুমান কিংবা কালী বা শিব সাজেন তাঁরা। খুব বেশি বৈচিত্রও থাকে না ছদ্মসাজে।
আজকাল বহুরূপীরা বিভিন্ন সরকারি প্রচারমূলক অনুষ্ঠানে ডাক পান। মাঝে মধ্যে তাঁদের নিয়ে নানা কর্মশালাও হয়। কেউ কেউ দেশের প্রতিনিধি হিসেবে বিদেশের মাটিতে বহুরূপীর সাজ দেখিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন। তবে এত কিছুর পরও উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তাঁদের সুদিন ফেরেনি। শহরে কখনও কখনও বাসে, ট্রামে তাঁদের কদাচিৎ দেখা যায়। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা রাধাকৃষ্ণ কিংবা কালীকৃষ্ণ সেজে ভিক্ষা করে। লোকাল ট্রেনেও ওঠে।
মেলা কিংবা হাটেবাজারে বাচ্চাদের পাশাপাশি বড়রাও পেটের তাগিদে ভিক্ষা করেন। বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানে তাঁদের ‘সং’-এর ভূমিকায় দেখা যায়। অথচ তাঁদের দিন এতটাও হতাশায় ঘেরা ছিল না। এক সময় তাঁরা শিল্পীর মর্যাদা পেতেন।
বছরের পর বছর টানা ৮-১০ দিন ধরে সাজ দেখিয়ে যাওয়ার সৌজন্যে এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে তাঁদের চেনাশোনার গণ্ডী ছাড়িয়ে একটা আত্মিক যোগ গড়ে উঠত। সেই জন্যে তাঁরা অনায়াসে গৃহস্থের সামনে ধামা কিংবা থলে পেতে দিয়ে নিঃসংকোচে বলতে পেরেছেন, ‘মাগো এতদিন দুধ ননী দিয়ে গেলাম, আজ তার দামটা দিন।’
এই কথায় একটা আবদারের সুর আছে। সেই সুর ভিক্ষা নয়, গৃহস্থকে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে অনুপ্রাণিত করেছে। সেই সুর কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। এক সময় দেশের প্রতিনিধি হিসেবে ব্রিটেন, রাশিয়া, জাপান-সহ বিভিন্ন দেশে বহুরূপী সাজ দেখিয়ে এসেছেন নানুরের কুলিয়া গ্রামের সুবল দাসবৈরাগ্য। তিনি বলেন, ‘তখন বহুরূপীদের একটা কদর ছিল। এখন আধুনিক বিনোদনের দাপটে বহুরূপীদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়েছে।’