ইন্দ্রজিৎ রায়, বোলপুর: আধুনিকতার ঠেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে একাধিক জনজাতির ভাষা। তার মধ্যে অন্যতম কোঁড়া। রাষ্ট্রসঙ্ঘের তালিকায় যা এনডেঞ্জারড্ বা বিলুপ্তপ্রায় ভাষা। এই ভাষার কোনও নিজস্ব বর্ণমালা কিংবা লিপি নেই। পাশাপাশি, কোঁড়া জনজাতির নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষায় পড়াশোনা করছে। ফলে কোঁড়া ভাষার চর্চা বা তা নিয়ে আগ্রহ নতুন প্রজন্মের মধ্যে নেই বললেই চলে। সম্প্রদায়ের প্রবীণরা যা নিয়ে উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি বিপন্নপ্রায় এই কোঁড়া ভাষা নিয়ে ‘গোট ফিশ স্নেক স্প্যারো’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন তিন তরুণ। যাঁদের মধ্যে একজন বিশ্বভারতীরই প্রাক্তনী। তাঁদের এই তথ্যচিত্র কানাডার ‘ডক্সা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এ প্রশংসা কুড়িয়েছে। শান্তিনিকেতন ও পাড়ুই থানার মধ্যবর্তী এলাকায় প্রবাহিত হয়েছে কোপাই নদী। এই নদী সংলগ্ন এলাকার কমলাকান্তপুরের একটি অংশে কোঁড়া জনজাতির বসবাস। মাত্র ৫০টি পরিবার। এই জনগোষ্ঠীর প্রবীণ সদস্যরা জানান, তাঁদের ভাষার কোনও লিখিত রূপ নেই। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মৌখিকভাবেই ভাষাটি চলে এসেছে। ফলে, যখন একজন প্রবীণ মানুষ মারা যান, তখন তাঁর সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু শব্দও বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই কারণে প্রতিনিয়ত কোঁড়া ভাষার শব্দভাণ্ডার কমে আসছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতে বর্তমানে প্রায় ১৯৭টি বিপন্নপ্রায় ভাষা রয়েছে এবং ৫টি ভাষা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের চিহ্নিত বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলির মধ্যে কোঁড়া অন্যতম। এটি কোড়ালি, কোডা, কোরে নামেও বিভিন্ন জায়গায় পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ এমনকী বাংলাদেশেও এই জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় বর্তমানে কমলাকান্তপুরের কোঁড়াপাড়ার প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষই এখন কোঁড়া ভাষায় কথা বলতে পারেন না, বিশেষত নতুন প্রজন্ম। একাদশ শ্রেণির ছাত্রী প্রিয়া কোঁড়া, বিশ্বভারতীর ছাত্র সুদীপ কোঁড়া বলেন, নতুন প্রজন্ম বাংলায় পড়াশোনা করায় কোঁড়া ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। যদিও ভাষাটিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। চর্চার অভাবই এর বিলুপ্তির অন্যতম কারণ।
চাষবাস ও পশুপালনই কোঁড়া জনজাতির মূল পেশা। এছাড়া, তালপাতার তালাই, শালপাতার থালা তৈরি, খড় দিয়ে দড়ি বানিয়ে তাঁরা বিকল্প আয়ের পথ খুঁজে নেন। গ্রামে পাকা রাস্তা নেই বললেই চলে, বেশিরভাগ বাড়িই কাঁচা এবং ভাঙাচোরা। আবাস যোজনার সুবিধা থেকেও বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ। প্রতি বছর বর্ষায় কোপাই নদী ফুঁসে উঠলে গ্রাম প্লাবিত হয়, যার ফলে তাদের জীবনধারণ আরও কঠিন হয়ে ওঠে। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর পক্ষে নিজেদের ভাষা বাঁচানোর লড়াই করা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই বিষয়গুলি জানতে পেরে তথ্যচিত্র বানানোর পরিকল্পনা করেন পুনে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার প্রাক্তনী অভ্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়, বিশ্বভারতীর সেন্টার ফর মাস কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজমের প্রাক্তনী শোয়েব আজম ও কলকাতার সিনেমাটোগ্রাফার স্নেহাশিস মিত্র। অভ্রদীপ এই তথ্যচিত্রের পরিচালক। ২০২৫ সালে ৩০ মিনিটের এই তথ্যচিত্রটি সম্পূর্ণ হয়। সম্প্রতি, কানাডার ডক্সা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়ে সকলের প্রশংসা কুড়োয়। শোয়েব বলেন, কোঁড়া জনগোষ্ঠীর হারিয়ে যাওয়া ভাষা, তাঁদের জীবনযাপন, জীবিকা ও সংস্কৃতি চর্চা নিয়ে তথ্যচিত্রটি তৈরি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য, হারিয়ে যেতে বসা কোঁড়া ভাষা ও সংস্কৃতিকে বাঁচানো।