৫ ঘণ্টায় ডবল ডিগবাজি! বীরভূমে কেষ্টর ‘শ্রেষ্ঠ’ আসন টলিয়ে দিল পুলিশকে অশালীন হুমকির একটি অডিয়ো ক্লিপ
আনন্দবাজার | ৩১ মে ২০২৫
অনুব্রত মণ্ডল শুক্রবার সকাল থেকে বিকেল— পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে ডবল ডিগবাজি খেলেন। জেল থেকে ফেরার পর নিজের মতোই ছিলেন। আগের ফর্মে তাঁকে আর দেখাও যাচ্ছিল না। জেলা সভাপতি পদও সম্প্রতি চলে গিয়েছে। এ বার বোলপুর থানার আইসি লিটন হালদারকে হুমকি দেওয়ার ভাইরাল অডিয়ো-কাণ্ডের পরে দলের কোপে পড়তে হল তাঁকে। অনুব্রতের ‘জগৎ’ বলতে বীরভূম জেলা। এত দিন সেই জগৎসভায় ‘শ্রেষ্ঠ’ আসন ছিল কেষ্টরই। এ বার সেটাও কি খোয়ালেন তিনি, রাজনৈতিক মহলে উঠেছে প্রশ্ন।
অতীতে পুলিশকে হুমকি দেওয়ার নজির কম নেই অনুব্রতের।কখনও পুলিশের দিকে বোমা মারতে দলীয় কর্মীদের নিদান দিয়েছেন। কখনও আবার ঘড়ি দেখিয়ে পুলিশ আধিকারিককে বলেছিলেন, ‘‘এখন ৪টে (বিকাল) বাজে। ৮টা (রাত) পর্যন্ত আপনাকে সময় দিলাম। না হলে আমি ঢুকে যাব। ভয়ঙ্কর খেলা খেলে দেব। একটা বাড়িও আস্ত রাখব না। একদম চড়িয়ে দেব। সব ক’টাকে অ্যারেস্ট করুন। এক ধার থেকে অ্যারেস্ট করুন!’’ কিন্তু পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। কার্যত পাশে থেকেছিল দলও। কিন্তু এ বার আর তা হল না। শুক্রবার সকালে আনন্দবাজার ডট কমকে অনুব্রত বলেছিলেন, অডিয়ো ক্লিপের কণ্ঠ তাঁর নয়। পরে সেই মত তাঁকেই বদল করতে হয়।
ভাইরাল অডিয়ো ক্লিপ
বৃহস্পতিবার রাত থেকে ভাইরাল হওয়া একটি অডিয়ো ক্লিপ ঘিরে তোলপাড় পড়ে যায় বীরভূম জেলা তৃণমূলে। একই সঙ্গে আন্দোলিত হয় প্রশাসনও। যে অডিয়ো ক্লিপটি ভাইরাল হয়েছে, তাতে এক জনকে ‘অনুব্রত মণ্ডল’ নাম নিয়ে বোলপুরের আইসিকে হুমকি দিতে শোনা যাচ্ছে। সেই অডিয়ো ক্লিপে বলা হয়েছে, ডেপুটেশন দিতে গিয়ে থানা থেকে বার করে আইসিকে পেটানো হবে। শুধু তা-ই নয়, বোলপুর থানার আইসির মা এবং স্ত্রীর উদ্দেশে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ শোনা যাচ্ছে। মিছিলের জমায়েতে পুলিশি রিপোর্ট নিয়ে আইসির বিরুদ্ধে তোপ দাগতেও শোনা গিয়েছে। ঝড়ের বেগে তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। যার জেরে চাপা পড়ে যায় আলিপুরদুয়ারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ এবং তার পাল্টা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবাবি সাংবাদিক বৈঠক।
অস্বীকার অনুব্রতের
শুক্রবার সকাল ১১টা নাগাদ আনন্দবাজার ডট কমের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল অনুব্রতের সঙ্গে। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘‘ভাইরাল অডিয়োর কণ্ঠস্বর কি আপনার?’’ জবাবে তিনি বলেন, ‘‘না।’’ তবে কি কেউ সাজিয়ে সমাজমাধ্যমে এই অডিয়ো ছড়িয়ে দিয়েছে? অনুব্রতের জবাব ছিল, ‘‘সেটা বলতে পারব না।’’ এর পরে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, ‘‘আপনি নাকি আইসিকে হুমকি দিয়েছেন?’’ অনুব্রত বলেন, ‘‘আমি কেন আইসিকে হুমকি দেব? আইসি এক জনকে মেরে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে। আমি ফোন করলে বলে, ফোন রাখ।’’ তার পরে আর প্রশ্ন করার সুযোগ দেননি অনুব্রত। তিনি ফোন কেটে দেন।
এফআইআর পুলিশের
বোলপুর থানার আইসি লিটন হালদারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে অনুব্রতের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ধারায় মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। শুক্রবার দুপুরে বীরভূমের পুলিশ সুপার আমনদীপ আনন্দবাজার ডট কমকে বলেন, ‘‘মিস্টার অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (বিএনএস)-র ২২৪ (সরকারি কাজে বাধা দেওয়া ও কর্তব্যরত কর্মীকে হুমকি), ১৩২ (সরকারি কর্মচারীকে হেনস্থা), ৭৫ (শ্লীলতাহানি ও হেনস্থা) এবং ৩৫১ (হুমকি) ধারায় মামলা রুজু হয়েছে।’’ পরে অনুব্রতকে বোলপুর পার্টি অফিসে গিয়ে নোটিসও দিয়ে এসেছে পুলিশ।
পদক্ষেপ দলের
শুক্রবার সকাল ১০টা-সাড়ে ১০টা থেকে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কাছে দলের মুখপাত্রেরা জানতে চান, অনুব্রত প্রশ্নে তাঁদের বক্তব্য কী হবে। তখন সর্বোচ্চ নেতৃত্বের তরফে বলা হয়, ‘নো কমেন্টস্’ বলার জায়গা নেই এখানে। কী বলতে হবে পরে পরিষ্কার করে দেওয়া হবে। তার পরেই দুপুর ২টো ৩২ মিনিট নাগাদ সমাজমাধ্যমে তৃণমূলের তরফে জানানো হয়, চার ঘণ্টার মধ্যে অনুব্রতকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। তৃণমূল বলছে, পুলিশের বিরুদ্ধে অনুব্রত মণ্ডল যা বলেছেন, তা দল অনুমোদন করে না। যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, দলের তরফে তার নিন্দা করা হচ্ছে।
ক্ষমা চেয়ে চিঠি
চাপের মুখে শেষমেশ ক্ষমা চান অনুব্রত। বীরভূমের ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ তৃণমূল নেতা ক্ষমা চাওয়ার প্রথম চিঠিতে লেখেন, ‘আমার ওই কথাগুলো বলা উচিত হয়নি। আমি দুঃখিত।’ সেই সঙ্গে কিছু প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। তাঁর প্রশ্ন, বোলপুরের আইসির সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের অডিয়ো কী ভাবে ফাঁস হল? অনুব্রতের প্রথম বয়ানে ছিল, ‘পুলিশের এক জন সাধারণ কর্মী থেকে বড় অফিসার সকলেই রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছের। তাঁদের অপমান করার কথা তিনি ভাবতেই পারেন না। তৃণমূল নেতা লেখেন, ‘সাম্প্রতিক ঘটনায় আমি দুঃখিত। দিদির পুলিশের কাছে এক বার কেন, একশো বার ক্ষমা চাইতে পারি। আসলে আমি নানা রকম ওষুধ খাই। দিদির পুলিশের বিরুদ্ধে কেউ কোনও অভিযোগ করলে মাথা গরম হয়ে যায়। সতিই আমি দুঃখিত।’ অর্থাৎ সকালে যা বলেছিলেন সেই অবস্থান থেকে সরে আসেন কেষ্ট। মেনে নেন কণ্ঠস্বর তাঁরই।
কথা বদল কেষ্টর
কিন্তু ওই বয়ানে সন্তুষ্ট হয়নি তৃণমূল। বোলপুরে পৌঁছয় কালীঘাটের বার্তা। বলা হয়, বাড়তি কথা নয়। শুধু ক্ষমা চাইতে হবে। নিঃশর্ত ক্ষমা। প্রথম চিঠি লিখেছিলেন বেলা ৩টে ১০ মিনিটে। দ্বিতীয় চিঠি লেখেন বিকাল ৪টেয়। দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর উদ্দেশে দু’লাইনের চিঠিতে কেষ্ট লিখেছেন, ‘আশা করি ভাল আছো। আমার প্রণাম নিও। সাম্প্রতিক ঘটনার জন্য আমি সামগ্রিক ভাবে সমস্ত স্তরের কাছে নিঃশর্ত ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।’ এই বয়ানে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা নেই। অর্থাৎ আবার ডিগবাজি।
গ্রেফতারের দাবি বিজেপির
অনুব্রতের অডিয়ো ক্লিপ নিয়ে তৃণমূলের উপর চাপ বাড়াতে শুরু করেছে বিজেপি। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অনুব্রতকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। আগামী ৯ জুন বোলপুরে অনুব্রতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচিরও ডাক দিয়েছে পদ্মশিবির।