• নিয়োগ কোন পথে, সব নজর সেই শীর্ষ কোর্টেই
    এই সময় | ০১ জুন ২০২৫
  • স্নেহাশিস নিয়োগী

    সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলো। কিন্তু এই নিয়োগের ভবিষ্যৎ কী, তা-ও পুরোটা নির্ভর করছে সুপ্রিম-রায়ের উপরেই! নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশে শিক্ষক এবং গ্রুপ-সি ও গ্রুপ-ডি পদে শিক্ষাকর্মী হিসেবে সব মিলিয়ে ৪৪,২০৩টি পদে নিয়োগের আশ্বাস দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে শুক্রবার এসএসসি যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে, তাতে শুধুমাত্র দুই ক্যাটিগরিতে শিক্ষক হিসেবে ৩৫,৭২৬টি পদে নিয়োগের উল্লেখ রয়েছে।

    তবে সাত পাতার এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ছত্রে ছত্রে উল্লেখ রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের কথা। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এই নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়াটাই নির্ভর করছে শীর্ষ কোর্টের পরবর্তী নির্দেশের উপরে। কারণ, ৩ এপ্রিল এসএসসি-র ২০১৬ সালের প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর পুরো প্যানেল বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছে, সেই রায়ের পুনর্বিবেচনা চেয়ে আলাদা আলাদা ভাবে রিভিউ পিটিশন করেছে রাজ্য সরকার, মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ও এসএসসি। এখনও পর্যন্ত সেই আবেদনের উপরে কোনও শুনানি হয়নি। শুনানির দিনও ধার্য হয়নি।

    আইনজ্ঞদের পাশাপাশি বিকাশ ভবনের কর্তাদের একটা বড় অংশ বলছেন, ওই পিটিশন যদি সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করে দেয় অথবা শুনানি করে কোনও নির্দেশ দেয়, তা হলে তার উপরেই এই গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এমনিতে সুপ্রিম-রায়ে চাকরিহারা তথাকথিত ‘নন-টেন্টেড’ বা ‘যোগ্য’ চাকরিহারারা চাইছেন, তাঁরা পরীক্ষায় বসবেন না এবং তাঁদের পূর্ণ মেয়াদের চাকরি নিশ্চিত করুক সরকার।

    ফলে এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নিয়ে তাঁরা ক্ষুব্ধ। আবার সেই বিজ্ঞপ্তিতে যে হেতু প্রায় প্রতিটি প্যারায় সুপ্রিম কোর্টের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে, তাই তাঁদের দুশ্চিন্তা আরও বাড়ল বই কমলো না। আর নতুন চাকরিপ্রার্থীরাও দুশ্চিন্তায় যে, রিভিউ পিটিশনের রায় যাই হোক না-কেন, তাতে এই বিজ্ঞপ্তি আবার সম্পূর্ণ বা আংশিক বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

    কেন পুরোনো ও নতুন, দুই অংশের চাকরিপ্রার্থীরাই এই বিজ্ঞপ্তির পরে চিন্তায়?

    আইনজ্ঞদের একটা বড় অংশ বলছেন, যদি রাজ্য ও এসএসসি-র রিভিউ পিটিশন কোর্ট খারিজ করে দেয়, তা হলে বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সবাইকেই পরীক্ষায় বসতে হবে। যে হেতু রাজ্য সরকার নিজে এর আগে শীর্ষ আদালতে জানিয়েছে যে, তারা রায় মেনে নিয়ে নতুন করে নিয়োগ করবে, তা হলে এই পিটিশনের যৌক্তিকতা থাকে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন আইনজ্ঞদের একাংশ। তবে সে ক্ষেত্রে তথাকথিত ‘যোগ্য’ প্রার্থীদের কথা মাথায় রেখে (যদিও সরাসরি বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা উল্লেখ নেই) স্কুলে পড়ানোর পুরোনো অভিজ্ঞতা ও লেকচার ডেমোর উপরে যে বাড়তি ১০ নম্বর করে মোট ২০ নম্বরের একটা অংশ রাখা হয়েছে, সেটা নিয়ে কোর্ট কী অবস্থান নেয়, তা দেখার।

    আইনজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, ৩ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের মূল রায় অথবা ১৭ এপ্রিল পর্ষদের মডিফিকেশন অ্যাপ্লিকেশনের উপরে কোর্ট যে রায় দিয়েছে, সেখানে কোথাও লেখা নেই যে নিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন বিধি তৈরি করতে পারবে না রাজ্য। ফলে এই বাড়তি নম্বরের বিধির ক্ষেত্রে সমস্যা থাকার কথা নয়। আইনজীবীদের অন্য অংশের ব্যাখ্যা, যে হেতু মূল রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বুঝিয়ে দিয়েছে ২০১৬-এর গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়াটাই বেআইনি, তাই ‘টেন্টেড’ বা ‘নিশ্চিত ভাবে অযোগ্য’ বলে চিহ্নিতদের পাশাপাশি ‘নন-টেন্টেড’দের চাকরিও খারিজ করা হয়েছে।

    নতুন বিধিতে স্পষ্টতই সুবিধা পাবেন পুরোনো ‘নন-টেন্টেড’ প্রার্থীরা। সেটা হলে ২০১৬-তে দুই ক্যাটিগরিতে শিক্ষক পদের জন্য পরীক্ষায় বসা প্রায় পৌনে তিন লক্ষ আবেদনকারীও দাবি করতে পারেন যে, তাঁদের এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। কারণ, একটা ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে যাঁরা শিক্ষকতার চাকরির অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন, সেটা কী ভাবে ‘বৈধ’ হয়? ফলে এই বিজ্ঞপ্তি চ্যালেঞ্জ হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ থেকে যাচ্ছে।

    আবার নতুন আবেদনকারীরাও চেয়ে রয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের দিকেই। কারণ, যদি সুপ্রিম কোর্ট রিভিউ পিটিশনে সাড়া দিয়ে ‘নন-টেন্টেড’দের চাকরি বহাল রাখে, তাহলে ৩৫ হাজার শূন্যপদের মধ্যে ১৫ হাজার এমনিতেই কমে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে কি নতুন পরীক্ষার্থীদের জন্য অভিজ্ঞতা বাবদ বাড়তি নম্বরের সংস্থান রাখার যৌক্তিকতা আদৌ থাকে? নাকি তখন সেই বিজ্ঞপ্তিটা বদলে যাবে?

    স্কুলশিক্ষা দপ্তরের এক আধিকারিকের ব্যাখ্যা, ‘রিভিউ পিটিশনের শুনানির উপরে অনেক কিছুই নির্ভর করছে। কারণ, রিভিউ পিটিশনের মাধ্যমে পুরোনো ‘নন-টেন্টেড’রা চাকরিতে বহাল হলে তখনই শূন্যপদের সংখ্যা কমবে। না-হলে এই বিজ্ঞপ্তি খুব বদল না-হওয়ারই সম্ভাবনা। তবে ২০১৬-এর বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীরা এই বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে আবার কোনও মামলা দায়ের করেন কি না, সে দিকেও নজর রাখতে হবে।’ তাঁর আরও যুক্তি, ‘এই বিজ্ঞপ্তির ছত্রে ছত্রে সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ পিটিশনের বিষয়টি উল্লেখ করতে হয়েছে এই কারণে যে, তা না-হলে আদালত বলতে পারে আমরা সুপ্রিম-নির্দেশ পুরোপুরিই মেনে নিয়েছি। আবার রিভিউ কেন? রিভিউ–নির্দেশের উপরেই সবটা নির্ভর করছে।’

    অতএব সব নজর সেই শীর্ষ আদালতেই। সুপ্রিম কোর্টে মূল মামলায় রায় দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না ও বিচারপতি সঞ্জয় কুমার। বিচারপতি খান্না ইতিমধ্যে অবসর নিয়েছেন। এখন কে দায়িত্ব নেবেন, নতুন ‘মাস্টার অফ রস্টার’ হিসেবে তা বর্তমান প্রধান বিচারপতি বিআর গভাই ঠিক করবেন। তবে যে হেতু আগের বেঞ্চের বিচারপতি কুমার এখনও কর্মরত, তাই নতুন বেঞ্চেও তাঁকেই রাখার কথা।

  • Link to this news (এই সময়)