এই সময়, বোলপুর: দু’–দু’বার পুলিশের নোটিস পেয়েও হাজিরা দেননি অনুব্রত মণ্ডল ওরফে কেষ্ট। তবে তাঁর গরহাজিরাকে ছাপিয়ে এখন বিতর্কের কেন্দ্রে একটি মেডিক্যাল সার্টিফিকেট।
পুলিশের কাছে গরহাজিরার কারণ হিসেবে শারীরিক অসুস্থতা সংক্রান্ত যে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট জমা দিয়েছিলেন তিনি, তা–ও এখন চলে এল তদন্তকারীদের স্ক্যানারে। প্রায় তিন বছর আগে এই কেষ্টকেই ‘বেড রেস্ট’–এর পরামর্শ দিয়ে লেখা অন্য এক ডাক্তারের মেডিক্যাল সার্টিফিকেট নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল।
তখন অবশ্য গোরু পাচার মামলায় কেষ্টকে হাজিরার জন্য লাগাতার নোটিস পাঠিয়ে যাচ্ছিল সিবিআই। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার কী ভাবে ‘রোগী’ অনুব্রতর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে দেখে ‘বেড রেস্ট’–এর পরামর্শ দিয়ে সার্টিফিকেট দিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল তখন।
আর এ বারও যে ডাক্তার কেষ্টকে পাঁচদিনের ‘বেড রেস্ট’–এর পরামর্শ দিলেন, সেই ডাক্তারবাবুকে নিয়েই তৈরি হয়েছে গুঞ্জন। সূত্রের দাবি, ওই মেডিক্যাল সার্টিফিকেটটি ‘শান্তিনিকেতন মেডিক্যাল কলেজ’ নামে একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ইস্যু করা। ওই হাসপাতালটির অন্যতম কর্ণধার আবার কেষ্ট ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত মলয় পিট।
সোমবার ওই হাসপাতালের দুই চিকিৎসককে বোলপুরের এসডিপিও অফিসে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব সেরে বেরনোর সময়ে তাঁরা কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
যার অসুস্থতা নিয়ে এত বিতর্ক সেই অনুব্রত এ দিন বলেছেন, ‘মাঝে তিন দিন মহামিছিল হয়েছিল। তখন ঘামে ভিজে গিয়েছিলাম। তারপর থেকেই শরীর খারাপ শুরু হলো। প্রচণ্ড ঠান্ডা লেগেছে। কাশি হচ্ছে, গলায় ব্যাথা, শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। ওটাই তো আসল রোগ আমার। আজ অনেকটা কফ বেরনোর পরে একটু ভালো আছি। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছেন।’ আজ, মঙ্গলবার তিনি কোভিড টেস্টও করাবেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু ডাক্তারি সার্টিফিকেট নিয়ে বিতর্কের ব্যাপারে সদুত্তর মেলেনি।
বোলপুর থানার আইসি লিটন হালদারকে ফোন করে অশ্রাব্য গালাগালি এবং তাঁর মা ও স্ত্রীয়ের নাম করেও হুমকি দেওয়ার মামলার তদন্তে গত শনিবার প্রথমবার কেষ্টকে তলব করে পুলিশ। সে দিন গরহাজিরার কারণে রবিবার ফের তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়। দ্বিতীয় নোটিসেও আসেননি অনুব্রত। বরং তাঁর হয়ে আইনজীবী বিপত্তারণ ভট্টাচার্য তদন্তকারী অফিসারের সঙ্গে কথা বলে জানান, কেষ্ট অসুস্থ।
ডাক্তার পাঁচদিনের বেড রেস্টের পরামর্শ দিয়েছেন। সূত্রের খবর,‘ শান্তিনিকেতন মেডিক্যাল কলেজে’র প্যাডে এক চিকিৎসকের সই রয়েছে ওই সার্টিফিকেটে। সেখানে লেখা হয়েছে, অনুব্রত মণ্ডলের জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট রয়েছে। তাই পাঁচদিনের বেড রেস্টের প্রয়োজন। গত ৩১ মে, রাত ৯টা ১৩ মিনিটে ইস্যু করা ওই মেডিক্যাল সার্টিফিকেটে ডাক্তার হিসেবে সই রয়েছে জনৈক এইচ চৌধুরীর। রেজিস্ট্রেশন নম্বর— WBMC87845।
রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের ডেটা অনুযায়ী এই রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে সার্চ করতে যে তথ্য উঠে আসছে তা হলো— ডাক্তার হিটলার চৌধুরীর নাম। যিনি চিনের কুনমিং থেকে ডাক্তারি পাশ করে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলে নাম নথিভুক্ত করেছেন। হিটলার চৌধুরী নামে এক চিকিৎসক বর্তমানে রামপুরহাট ১নং ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক (বিএমওএইচ)। কেষ্টর সার্টিফিকেটের এইচ চৌধুরী, মেডিক্যাল কাউন্সিলে ওই রেজিস্ট্রেশন নম্বরের হিটলার চৌধুরী এবং এই বিএমওএইচ কি একই ব্যক্তি— জল্পনা তৈরি হয়েছে এখানেই।
কারণ, যদি বিএমওএইচ–ই ‘শান্তিনিকেতন মেডিক্যালে’র প্যাডে সার্টিফিকেট দিয়ে থাকেন, সেটা কি তিনি করতে পারেন? একজন সরকারি স্বাস্থ্য আধিকারিক কী ভাবে প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা করেন? তা না–হলে কি বিএমওএইচ–এর সই ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার করে অন্য কেউ এই সার্টিফিকেট ইস্যু করলেন? সে ক্ষেত্রে কি ওই সার্টিফিকেট বৈধ বলে গণ্য করা যায়?
সংবাদমাধ্যমে বিএমওএইচ হিটলার চৌধুরী ফোনে বলেন, ওই রেজিস্ট্রেশন নম্বর তাঁর নয়। তা হলে তাঁর রেজিস্ট্রেশন নম্বর কত? মেডিক্যাল সার্টিফিকেটে সইটা কি তাঁর? এ সব প্রশ্নের জবাব আসেনি। কারণ, তিনি ফোন কেটে দেন। তারপরেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বারবার ফোন ও মেসেজ করা হলেও জবাব আসেনি। তবে জলঘোলা যে শুরু হয়েছে, তা স্পষ্ট।
কারণ, বিতর্ক শুরু হতেই রামপুরহাট স্বাস্থ্য জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক শোভন দে ওই চিকিৎসককে তলব করেছেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে শোভন বলেন, ‘ওই মেডিক্যাল সার্টিফিকেটে কে স্বাক্ষর করেছেন, জানি না। তবে সরকারি স্বাস্থ্য দপ্তরের পদে থেকে কারও প্রাইভেট প্র্যাকটিস করার অধিকার নেই। যদি উনি (বিএমওএইচ হিটলার চৌধুরী) এটা করে থাকেন, তা হলে ওঁর দায়।’
এ দিন শান্তিনিকেতন মেডিক্যাল কলেজের কর্ণধার মলয় পিটকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘মিটিংয়ে আছি। পরে কথা বলব।’ তারপরে তাঁর আর কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ঘটনাচক্রে গোরু পাচার মামলায় মলয় পিটকে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল দুই কেন্দ্রীয় এজেন্সি সিবিআই ও ইডি। বেশকিছু নথিপত্রও তিনি জমা দিয়েছিলেন।
তবে এ বার কেষ্টর মেডিক্যাল রিপোর্ট নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তা অনেককেই মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০২২–এর অগস্টের ঘটনা। সে সময়ে গোরু পাচার মামলায় সিবিআইয়ের তলব পেয়েও বারবার তা এড়িয়ে যাচ্ছিলেন অনুব্রত। তার মধ্যে একবার শারীরিক অসুস্থতার কারণ দর্শাতে গিয়ে ‘বেড রেস্ট’–এর একটি ডাক্তারি সার্টিফিকেট জমা দিয়েছিলেন তিনি।
বোলপুরের সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার কেন বাড়িতে গিয়ে তাঁকে দেখে সাদা কাগজে সার্টিফিকেট দিলেন, তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। পরে অবশ্য সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক জানান, তিনি হাসপাতালের সুপারের নির্দেশেই গিয়েছিলেন কেষ্টর বাড়িতে। ওই চিকিৎসক ও সুপারকেও সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়েছিল।
এ বার কী হবে? কী করবে পুলিশ? আইনজ্ঞদের একাংশ বলছেন, দু’বার নোটিস দেওয়ার পরেও কেষ্ট হাজিরা না–দেওয়ায় পুলিশের অবশ্যই খতিয়ে দেখা উচিত যে তিনি যে কারণ দেখিয়ে গরহাজির রইলেন, তা কতটা যুক্তিসঙ্গত।
তাতে যদি পর্যাপ্ত যুক্তির অভাব থাকে অথবা সত্য গোপন করে থাকেন কেষ্ট, তা হলে তাঁকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে আদালতে বিষয়টি জানাতে পারে। এ ক্ষেত্রে তো মেডিক্যাল সার্টিফিকেট নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেল। এখন তদন্তকারীরা কী করবেন, সেটাই দেখার।
যদিও অবিলম্বে কেষ্টর গ্রেপ্তারি দাবি করে চাপ বাড়াচ্ছে বিরোধীরা। কেষ্টকে গ্রেপ্তারির দাবি জানিয়ে ৯ জুন বোলপুরে মিছিল করার কথা বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর।