মারার হুমকি দেন, ‘ওঁর সঙ্গে অভিনয় করতে ভয় লাগে’, বলতেন অশোককুমারও
আনন্দবাজার | ০৩ জুন ২০২৫
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ভাল রকম তালিম নিয়েছিলেন। একাধিক ছবিতে তাঁকে দিয়ে গাইয়েছিলেন পরিচালকেরা। শোনা যায়, অনেক সময়েই বাইরে শুটিং করতে গেলে সঙ্গে যেত ওঁর নিজস্ব তানপুরাও। এক বার একটি ছবির শুটিং চলাকালীন সহ-অভিনেত্রী ভারতী দেবী নাকি তাঁর কাছে একটি সংলাপ বলার ব্যাপারে পরামর্শ চাইতে গিয়েছিলেন। তিনি তখন পিছন ফিরে তানপুরা নিয়ে রেওয়াজে ব্যস্ত। ভারতী দেবীর ‘আর্জি’ শুনে ঘাড় পর্যন্ত না ঘুরিয়েই রুক্ষ স্বরে বলেছিলেন, তিনি কাউকে কিছু দেখিয়ে-টেখিয়ে দিতে পারবেন না। ও সবের জন্য তো ডিরেক্টর রয়েছেন! বিব্রত ভারতী দেবী আর কিছু না-বলে ‘অ্যাবাউট টার্ন’ করে ফিরে আসছিলেন। অমনি পিছন থেকে বজ্র হুঙ্কার, ‘দুম করে এসে অমনি চলে গেলেই হয় না!’ ভারতী দেবী পিছনে ঘুরে দেখলেন, মহিলা এ বার তাঁর দিকেই ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে। ‘কোথায়, কী অসুবিধা হচ্ছে?’ এর পর সংলাপের ধরন দেখিয়ে তো দিলেনই, তার উপর ভারতী দেবীর সঙ্গে মেতে গেলেন গল্পে-গানে। ছবির নাম ‘নির্জন সৈকতে’। আর মেজাজি মহিলা হলেন ছায়া দেবী। আসলে ওঁর কাছের মানুষদের স্মৃতিচারণে ছায়া দেবীর চরিত্রের এই দিকটা বার বার স্পষ্ট হয়েছে। ওঁর জাঁদরেল, রাশভারী, বদমেজাজি বহিরঙ্গের আড়ালে সব সময়েই এক জন স্নেহপ্রবণ মানুষ থাকতেন। নিজের মতো করে উনি ভালবাসতেন, রসবোধও ছিল মারাত্মক। কিন্তু যেটা সহ্য করতে পারতেন না, তা হল লোকদেখানো আদিখ্যেতা।
পর্দায় তাঁকে প্রধানত তিন ধরনের চরিত্রে দেখা গিয়েছে। এক, কুঞ্চিত-ভ্রু ব্যক্তিত্বশালিনী। দুই, অতীব সংযত, মিতভাষী, রাশভারী ব্যক্তিত্ব। আর তিন, মমতাময়ী, কিন্তু রাশভারী (এবং প্রয়োজনে মেজাজি) প্রৌঢ়া মা। ছায়া দেবী, ওরফে কনকবালা গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯১৪ সালের ৩ মে, ভাগলপুরে। সেখানকার সম্পন্ন বাঙালি পরিবারের কন্যার তদানীন্তন দেশাচার মেনে বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১১ বছর বয়সে, স্কুলের পাট মাঝপথেই চুকিয়ে। বিয়ের পরে মেয়েটি শুনল, স্বামী তাকে নিয়ে সংসার পাততে অপারগ। জেদি স্বভাব বোধহয় তাঁর ছোটবেলা থেকেই। সব শুনে মেয়েটি নিজের সিদ্ধান্তেই বাপের বাড়ি ফিরে আসে। এর পর পরিবারের সস্নেহ প্রশ্রয়ে মন দেয় সঙ্গীত ও নাচের চর্চায়। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি কত্থক নাচেরও তালিম নিয়েছিলেন ছায়া দেবী। ‘উত্তরফাল্গুনী’, ‘মমতা’, ‘হারমোনিয়ামে’ তার নিদর্শন পাওয়া যায়। জানতেন ঘোড়ায় চড়তেও। এই সব প্রতিভার সূত্রেই অভিনয়ের জগতে প্রবেশ কনকের। ছবির দুনিয়ায় যখন পা রাখেন, তাঁর নাম দেওয়া হল ছায়া। তত দিনে ভাগলপুরের পাট চুকিয়ে ছায়া দেবীর পরিবার চলে এসেছে উত্তর কলকাতার সিমলে অঞ্চলে।
সেখানে প্রতিবেশী তখনকার কিংবদন্তি গায়ক-অভিনেতা কৃষ্ণচন্দ্র দে। তাঁর ভাইপো মান্না দে ছায়া দেবীর চেয়ে কয়েক বছরের ছোট। তাই দু’জনের সখ্য গড়ে উঠতে সময় নেয়নি। বস্তুত দে পরিবারের সঙ্গে গঙ্গোপাধ্যায় পরিবারের বেশ সুসম্পর্ক ছিল। শোনা যায়, এক বার এক সঙ্গীতশিল্পী, সঙ্গীত-গবেষক তথা তরুণ সাংবাদিক তাঁর সিমলের বাড়িতে গিয়েছিলেন সাক্ষাৎকার নিতে। সাক্ষাৎকার দেওয়ার ব্যাপারে শুধু অনীহাই নয়, ঘোর বিরক্তিও ছিল ছায়া দেবীর। সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকের আগমনের হেতু শুনে নাকি চিড়বিড়িয়ে বলে উঠেছিলেন, ‘সাক্ষাৎকার! বড় বড় কথা বলছ ছোকরা! মারব এক রদ্দা!’ অভিনেত্রীর মুখে এ-হেন সংলাপ শুনে সাক্ষাৎকারপ্রার্থী সাংবাদিক পালাতে পথ পান না। পরে ছায়া দেবীর পড়শি মান্না দে’র ভাইপো সুদেব দে-কে বলে রাজি করিয়ে সেই সাক্ষাৎকার অবশ্য নেওয়া গিয়েছিল। এমনই দাপুটে, অথচ সমঝদার মানুষ ছায়া দেবী। বটুয়া থেকে খৈনি বের করে খাওয়ার অভ্যাস ছিল তাঁর। এ নিয়ে কেউ মন্তব্য করলে বলতেন, ‘কেন, সিগারেট, মদ খেলে তো কেউ কিছু বলো না! খৈনি খেলেই যত দোষ!’
স্বাধীনচেতা ছিলেন বরাবর। বাল্যাবস্থায় বিয়ে ভাঙার পরে ছায়া দেবী আর কখনও বিয়ে করেননি। একাই থেকেছেন। তবে পরিবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল অটুট। পরবর্তী সময়ে তাঁর কাছের মানুষেরা বারে বারে জানিয়েছেন, বাইরের প্রায় রুক্ষ কঠোর ইমেজের আড়ালে ছায়া দেবী বরাবরই এক স্নেহপ্রবণ মানুষ। আর এক প্রবাসী খাণ্ডোয়ার গঙ্গোপাধ্যায় পরিবার, অর্থাৎ অশোককুমার, কিশোরকুমার, অনুপকুমারদের সঙ্গেও ছায়া দেবীরা পারিবারিক সম্পর্কে যুক্ত। দাদামণি অশোককুমার ছিলেন ছায়া দেবীর অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ। বলতেন, ‘বয়সে ছোট হলেও ওঁর সঙ্গে অভিনয় করতে ভয় লাগে। ভীষণ মুডি, ভয়ঙ্কর আনপ্রেডিক্টেবল।’ কয়েকবার অশোককুমারের উদ্যোগে মুম্বই গিয়ে হিন্দি ছবিও করেছেন ছায়া দেবী। যদিও খাণ্ডোয়ার গঙ্গোপাধ্যায় ভাইদের প্রসঙ্গ উঠলেই তিনি দাঁত কিড়মিড় করে বলতেন, ‘ওরা হল পাগলের ঝাড়। ঝাড়ে-বংশে পাগল সব।’
ছায়া দেবী সম্পর্কে আলোচনায় আর একটা কথা জরুরি। ওঁর সমসাময়িক অভিনেত্রীদের তুলনায় অভিনয়ের গুণাগুণ বাদ দিলেও ছায়া দেবী ছবির পর্দায় যেটা সফল ভাবে তৈরি করতে পেরেছিলেন সেটা হল, যাকে বলা যেতে পারে একটা প্রবল উপস্থিতি। যেটা এক কথায় ‘মনুমেন্টাল’। ছবি বিশ্বাস, তুলসী চক্রবর্তীর প্রয়াণের পরে সত্যজিৎ রায়ের মূল্যায়নে যেটা ফুটে উঠেছিল, সেটা বোধহয় ছায়া দেবীর সম্পর্কেও খাটে। আজকের দিনে ছবিতে অনেক রকম পরীক্ষানিরীক্ষা হচ্ছে, সমাজের অনেক স্তরের অনেক ধরনের চরিত্র তাদের বিচিত্র টানাপড়েন, সংঘাত-সঙ্ঘর্ষ নিয়ে দর্শকের সামনে আসছে। মনে রাখতে হবে, ছায়া দেবী যখন অভিনয় করেছেন, এত সুযোগ তাঁর সামনে ছিল না। ফলে, তাঁর অভিনীত চরিত্রেরা সাধারণ ভাবে তিন-চারটি ছক বা টাইপের মধ্যেই পড়ে। তার মধ্যেও যখনই পেরেছেন, কিছু সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যের আমদানি করতে ছাড়েননি। আর সেটার সঙ্গে পূর্ণ সঙ্গত দিয়েছে ওঁর বেশি বয়সের চেহারা— বিশেষ করে ছেনি কাটা মুখাবয়ব ও চোখের ব্যবহার। এখানে উদাহরণ হিসাবে হিরণ্ময় সেনের ‘বর্মার পথে’ (১৯৪৭) ছবির উল্লেখ করা যেতে পারে। স্বাধীনতার পর পরই মুক্তি পেয়েছিল সেই ছবি। বিপরীতে অহীন্দ্র চৌধুরীর জাঁদরেল উপস্থিতি থাকলেও গোটা ছবিতে যদি দর্শনীয় কিছু থাকে, তা হল ছায়া দেবীর অভিনয়। ‘বর্মার পথে’ যে ধাঁচের চরিত্রাভিনয় উনি শুরু করেন, সেটারই একটা পরিণতি দেখা যায় দেবকী বসুর সুপারহিট ছবি ‘রত্নদীপ’-এ (১৯৫১)।
পাঁচের দশকের শেষ এবং ষাটের দশকের গোড়া থেকেই ছায়া দেবীর চরিত্রাভিনয় তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। যার প্রথম স্বাক্ষর অজয় করের ‘সপ্তপদী’। রিনা ব্রাউনের (সুচিত্রা সেন) গর্ভধারিণী মাকে যেখানে সামাজিক লাঞ্চনা এড়াতে ‘বাধ্য’ করা হয় মেয়ের দেখভাল করা আয়া হিসাবে কাজ করতে এবং শেষ মেয়েকে বাঁচাতে নিজেকেই গুলির সামনে বুক পেতে দিতে হয়। সংক্ষিপ্ত, সংহত, সংযত, নির্বাক চরিত্রটি রিনা ব্রাউনের গোড়ার দিকের উচ্ছ্বল চরিত্রের শুধু বিপরীতই নয়, কাহিনির গতিমুখ নির্ধারণ করার পিছনেও অবশ্যম্ভাবী।
‘নির্জন সৈকতে’ ছবিতে ট্রেনে অনিল চট্টোপাধ্যায়কে মুখ ঝামটা দেওয়া, ‘পদীপিসির বর্মীবাক্স’-তে (ছবিটা আর পাওয়াই যায় না বলে শোনা যায়) পদীপিসির দাপট, ‘থানা থেকে আসছি’র পুলিস ইনস্পেক্টরকে দাঁতে পিষে দৃষ্টিতে ভস্ম করার মতো দৃশ্য আজও অবিস্মরণীয়। এ সব দেখে সম্পূর্ণ অকারণেই, মনের মধ্যে উঁকি দেয় ‘দ্য ইম্পর্ট্যান্স অফ বিয়িং আর্নেস্ট’-এ লেডি ব্র্যাকনেলের চরিত্র বা কেনেথ ব্রানার ‘হ্যামলেট’-এ হেকুবার ভূমিকায় জুডি ডেঞ্চের অভিনয়। অথবা মনে করায় ‘দ্য লায়ন ইন উইন্টার’-এ ইলিনর অফ অ্যাকুইটেইনের ভূমিকায় বর্ষীয়সী ক্যাথরিন হেপবার্নকে।
মধ্যবিত্তের মাপে ঢালা ঝিঙেপোস্ত মার্কা ছবির উপরে উঠে বাঙালি পরিচালকেরা যদি ওই উচ্চতায় কাজ ভাবতে পারতেন, তা হলে হয়তো ছায়া দেবীদের মতো চরিত্রদের থেকে এমন কিছু মিলত যা এখনও অভাবনীয় হয়ে থেকে যেতে পারত।