সুনন্দ ঘোষ
কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে বসা অফিসারের দিকে পাসপোর্টটা এগিয়ে দিলেন বাংলাদেশি যুবক। মেডিক্যাল ভিসা নিয়ে এ দেশে এসেছেন চিকিৎসা করাতে।
কলকাতায় চিকিৎসা করাবেন? উত্তর আসে, ‘না। দিল্লি যাব।’ কীসের চিকিৎসা? বিস্তারিত জানতে চাইলে যুবক এগিয়ে দেন একগাদা প্রেসক্রিপশন। উলটে-পালটে ইমিগ্রেশন অফিসারের সন্দেহ হয়।
প্রেসক্রিপশনে বেশ কঠিন অসুখের কথা লেখা আছে। অফিসারের যতটুকু ধারণা, সেরকম অসুখ হলে তার প্রভাব পড়ার কথা চোখে–মুখে। কিন্তু, কাউন্টারের ও পারে দাঁড়ানো যুবককে দেখে তো বেশ সুস্থই মনে হচ্ছে। প্রশ্ন জাগে, কঠিন অসুখের চিকিৎসায় তো লোকে সাধারণত, মুম্বই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু যান। আচমকা দিল্লি কেন? সন্দেহ ঘনীভূত হয়। শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসে বেড়াল।
জানা যায়, অসুখ-বিসুখ স্রেফ ভাঁওতা। যুবক সোজা পথে ভারতের ভিসা পাচ্ছিলেন না। তাই, নিজের দেশের দালাল ধরে প্রায় এক লক্ষ বাংলাদেশি টাকা দিয়ে তিনি ওই ভিসা নিয়েছেন। তার জন্য জাল মেডিক্যাল সার্টিফিকেট জোগাড় করে দিয়েছেন দালাল। ভারতে আসার এত প্রয়োজন কেন?
পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ভেঙে যাওয়া বালটিক সমুদ্রের ধারে ছোট একটি দেশ এস্টোনিয়া। জানা গিয়েছে, সেখানেই পড়তে যেতে চান এই যুবক। তাঁর প্রয়োজন এস্টোনিয়ার ভিসা। কিন্তু, বাংলাদেশে বসে সেই ভিসা পাওয়া যায় না।
কারণ, এস্টোনিয়ার কোনও দূতাবাস ঢাকায় নেই। দিল্লিতে রয়েছে। তাই, বাংলাদেশের যত পড়ুয়া সে দেশে পড়তে যেতে চান, তাঁরা অনলাইনে আবেদন করলেও, তাঁদের সীমান্ত টপকে সেই ভিসার ইন্টারভিউ দিতে একবার অন্তত দিল্লিতে আসতেই হয়।
আগে এই কারণে দিল্লি আসার জন্য ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসে আবেদন করলে সহজেই ভিসা মিলছিল। কিন্তু, গত বছরে অগস্টের পরে পরিস্থিতি পাল্টেছে। কলকাতা বিমানবন্দর সূত্রের খবর, সে দিন সেই যুবককে পত্রপাঠ ফেরত পাঠানো হয় ঢাকায়।
সূত্রের খবর, মাঝেমধ্যেই কলকাতা বিমানবন্দরে নাকি এই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, শুধু মে মাসেই এমন ১৪ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশে। তাঁরা সকলেই দিল্লিতে ভিসার ইন্টারভিউ দেবেন বলে জাল মেডিক্যাল ভিসা নিয়ে ভারতে এসেছিলেন।
ইউরোপের অন্য দেশ বা আমেরিকা–ক্যানাডার তুলনায় এস্টোনিয়ায় পড়ার খরচ তুলনায় কম। উল্টে সেখানে স্কলারশিপের সুযোগও মেলে। সেই তালিকায় রয়েছে ফিনল্যান্ড, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, অস্ট্রিয়া, লিথুয়ানিয়া, স্লোভাকিয়ার মতো অনেক দেশ।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, এই সব দেশের কোনও দূতাবাস নেই বাংলাদেশে। এ সব দেশে পড়তে যাওয়ার জন্য ভিসা করাতে তাই বাংলাদেশি পড়ুয়াদের নয়াদিল্লিতে আসতে হয়। এস্টোনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বেশিরভাগ সেশনই অগস্ট নাগাদ শুরু হয়। তাই, ফেব্রুয়ারি থেকে ভিসা করানোর তোড়জোড় শুরু হয়। এই মে-জুনে ভিসা ইন্টারভিউয়ের লাইন পড়ে।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, ঢাকা থেকে তো দিল্লির সরাসরি উড়ান রয়েছে। তাতে না গিয়ে কলকাতায় কেন আসছেন এঁরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের ব্যাখ্যা, দিল্লিতেও ওঁরা রিফিউজ়ড হচ্ছেন। তা ছাড়া বাংলাদেশিদের জন্য কলকাতা অনেক কমফর্টেবল জায়গা। বিশেষত যাঁরা এই জাল নথি নিয়ে আসেন, তাঁরা কলকাতায় নেমে বাঙালি অফিসারদের ‘ফেস’ করতে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
প্রশ্ন উঠছে, কলকাতা নেমে দিল্লি যাওয়ার কথা বললে যদি সন্দেহ হয়, তা হলে তাঁরা চোখে ধুলো দিতে মুম্বই–বেঙ্গালুরু গিয়ে, সেখান থেকেও তো দিল্লি যেতে পারেন? তা হলে তো ঝামেলা এড়ানো যায়। অফিসারের কথায়, ‘দিল্লির হোটেল বুকিংয়ের খবর তো আমরা সিস্টেমেই দেখতে পেয়ে যাই। পালাবে কোথায়?’
যত সময় বাড়ছে, ততই ভারত বিদ্বেষের বীজ বপন করা হচ্ছে বাংলাদেশে। সেখানে সক্রিয় হচ্ছে পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। এই আবহে কড়া হচ্ছে সে দেশ থেকে ভারতে ঢোকার নিয়ম। সূত্রের দাবি, ভারতে আসার জন্য এখন আর চাইলেই ট্যুরিস্ট ভিসা পাচ্ছেন না বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসার এখন সহজতর উপায় মেডিক্যাল ভিসা। আর তাকে ঘিরেই শুরু হয়েছে জালিয়াতি।