বাংলায় আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা ব্যবস্থা, তবু কেন অন্ধবিশ্বাস দক্ষিণে? কারণ অমিল...
আজকাল | ০৩ জুন ২০২৫
গোপাল সাহা
২০১১ সালের রাজ্যের সরকার বদল হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ গ্রহণ করেন মমতা ব্যানার্জি এবং একই সঙ্গে তিনি স্বাস্থ্য দপ্তরের দায়িত্ব নিজের হাতে রাখেন। দায়িত্ব নিয়েই তিনি স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য একাধিক পদক্ষেপ করেছেন এবং ঢেলে সাজিয়েছেন বাংলার স্বাস্থ্য পরিষেবাকে। তাও অনেকেই অকারণে দক্ষিণের রাজ্যে ছোটেন চিকিৎসা পেতে, যা অন্ধবিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই নয়, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
অকারণেই, রাজ্যের বহু সংখ্যক মানুষ এখনও বিশ্বাস করেন ভিনরাজ্যে ভাল চিকিৎসা হয়। এই রাজ্যেও সরকারি এবং বেসরকারি উভয়ক্ষেত্রেই অনেক প্রথিতযশা চিকিৎসক আছেন। কিন্তু 'গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না', এই প্রবচনের মতোই বাংলার চিকিৎসকরা সারা বিশ্বে বন্দিত হলেও, নিজের রাজ্যেই অবিশ্বাসের স্বীকার।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্বাস্থ্য পরিষেবা আরও উন্নত করতে পূর্বেই শুরু হয়েছিল 'রোগী কল্যাণ সমিতি'। স্বাস্থ্য পরিষেবায় সাবলিলতা আনতে শুরু হয়েছে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড। যাতে নিম্নবিত্ত মানুষ সকল সাধারণ মানুষের চিকিৎসা পরিষেবা পেতে কোনও সমস্যা না হয় এবং কোনও গাফিলতি না হয়। এর পরেও কিছু মানুষ ভিন রাজ্যে চলে যাচ্ছেন চিকিৎসার কারণে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রতি মাসে আনুমানিক এক লক্ষ মানুষ চিকিৎসার কারণে ভিনরাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। ডেভেলপমেন্ট ইন্টালিজেন্স ইউনিট (Development Intelligence Unit or DIU)-এর ২০২৩-২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, পূর্ব ভারতের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ-সহ জনসংখ্যার নিরিখে ২৭% মানুষ মূলত ভিনরাজ্যের উপর ভরসা করে চিকিৎসা করাচ্ছেন।
২০১৮-১৯ সালে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের অধীনস্থ 'নীতি আয়োগ'-এর মানদণ্ডে সারা ভারতবর্ষের সেরা হাসপাতালের শিরোপা অর্জন করেছিল এম আর বাঙুর হাসপাতাল। সম্প্রতি আইআইআরএফ-এর ক্রমপর্যায়ে সারা দেশের মধ্যে উৎকর্ষতায় নবম স্থান ও পূর্বভারতের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটপালক যোগ হয়েছে এশিয়ার প্রাচীনতম হাসপাতাল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মাথায়।
সারা দেশে ২০২৪ সালে 'ওয়েলনেস ট্যুরিজম' বা 'মেডিকেল ট্যুরিজম'-এ আমাদের দেশ প্রায় ১৯.৫ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি ছাড়াও আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সিংহভাগ বাংলাদেশ, নেপাল, ভূটান, মায়ানমার, থাইল্যান্ড থেকে মানুষ চিকিৎসা করাতে আসেন মূলত শিলিগুড়ি ও কলকাতায়। তাও দক্ষিণ ভারতের অন্যতম চিকিৎসাকেন্দ্র ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ, ভেলোরের অর্ধেকেরও বেশি রোগীরা হলেন বাঙালি। যদিও ভাষাগত সমস্যায় অনেক বাংলাদেশি নাগরিকেরাই ইএম বাইপাসের বেসরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসা করাতে স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করেন। কিন্তু যেতে চান না সরকারি হাসপাতালগুলিতে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রতি মাসে আনুমানিক এক লক্ষেরও বেশি যে সমস্ত রোগীরা ভিনরাজ্যে যাচ্ছেন তাঁদের চিকিৎসার গড় খরচ আনুমানিক ৮০ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কে অর্থনৈতিক দিক বিপুল ক্ষতির পরিমাণ বহন করতে হচ্ছে। রাজ্য থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, প্রতি মাসে প্রায় ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকা। এই পরিমাণ অর্থ বাংলায় থাকলে রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো আরও অনেক বেশি উন্নত হতে পারতো।
আজকাল ডট ইন-এর তরফ থেকে এই বিষয়ে কথা বলা হয়েছিল ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের চিকিৎসক রঞ্জন ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তিনি বলেন, "রাজ্যে এখন স্পেশালিটি-মাল্টি স্পেশালিটি-সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল অনেক তৈরি হয়েছে। চিকিৎসক ঘাটতিও অনেকটা কমেছে। স্বেচ্ছায় হোক বা 'বন্ড পোস্টিং'-এর দৌলতেই হোক অন্তত তিন বছর গ্রাম বা মফসসলে ডাক্তারদের থাকতেই হচ্ছে। অন্তত দু’টি দিকে আরও যত্নবান হতে হবে। প্রথমত, চিকিৎসকদের মানবিক মুখ ও ব্যবহার এবং দ্বিতীয়ত, ডা: দেবী শেট্টি বা ডা: নারায়ণ রেড্ডির মতো 'হেলথ কেয়ার ইন্ডাস্ট্রি'-তে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো চিকিৎসক।"
তিনি আরও বলেন, "রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও মানবিক ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকেই বিষোদ্গার করেন, কিন্তু সরকারি উদ্যোগে, স্বচ্ছতা ও বিনম্রতার সঙ্গে 'লো কস্ট এফেক্টিভ কেয়ার ইউনিট' আমাদের রাজ্যে রয়েছে। ন্যায্য মূল্যে ন্যূনতম লাভে, 'ব্রেক-ইভেন পয়েন্ট'-এর ঊর্ধ্বে হেলথ কেয়ার এস্টাব্লিশমেন্টগুলিকে বাঁচার রসদ দিয়ে, সরকারি উদ্যোগে উৎকর্ষতা আরও বৃদ্ধি করা যায়। তাই আমরা চাইবো ভেলোর, ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ, চেন্নাইগামী ট্রেন ও বিমানগুলি পর্যটকে ভরুক, রোগীতে নয়।"