এই সময়: ডিভোর্সি এক তরুণী তাঁর নাবালিকা কন্যাকে নিয়ে লিভ-ইন সম্পর্কে থাকতেন এক ডিভোর্সি যুবকের সঙ্গে। তরুণীর মেয়ে নিজের বাবার চোখে দেখত তাঁর মায়ের লিভ-ইন সঙ্গীকে। তবে গত বছর ওই তরুণী অভিযোগ আনেন যে, তাঁঁর লিভ–ইন পার্টনার ওই যুবক তাঁর নাবালিকা কন্যার শ্লীলতাহানি করেছেন।
পকসো আইনে মামলা হয়। সেই ইস্তক, গত বছরের অগস্ট থেকে ওই যুবক ছিলেন জেলে। কিন্তু মঙ্গলবার কলকাতা হাইকোর্টে ওই তরুণের জামিন-মামলায় অভিযোগকারিণী তরুণী নিজেই তাঁর লিভ-ইন পার্টনারের জন্য জামিন চেয়ে কাতর আবেদন করলেন।
এ দিন হাইকোর্টে ওই তরুণীর বক্তব্য, ‘পাপা’-কে দেখতে না-পেয়ে তাঁর মেয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। হাইকোর্টে ওই জামিন মামলায় তরুণী হাতজোড় করে বিচারপতির উদ্দেশে বলেন, ‘আমার বাচ্চা ওর পাপাকে মিস করছে, কান্নাকাটি করছে। আমার বয়ফ্রেন্ড জেলে মরছে। আমি জেলের বাইরে মরছি। আমার বাচ্চাও মরতে বসেছে।’
বিচারকের উদ্দেশে তরুণীর কাতর মিনতি, ‘আমি চাই, আমার বয়ফ্রেন্ডের জামিন হোক। এ কথা নিম্ন আদালতে হলফনামা দিয়েও জানাতে চেয়েছিলাম। তবে নিম্ন আদালত তা গ্রহণ করেনি। আমাকে হাইকোর্ট দয়া করুক।’
হাইকোর্ট সূত্রের খবর, বিচারপতি প্রসেনজিৎ বিশ্বাস কিছুটা যেন হতবাক হয়ে যান তরুণীর এমন কথায়। তার পর অভিযুক্ত যুবকের জামিনের আবেদন মঞ্জুর করে আদালত।
বিধাননগরে ওই পকসো মামলা রুজু হয়েছে। সেখানে অভিযোগকারিণী নিজেই অভিযুক্তর জামিনে মুক্তি চান বলে জানানোর পর ওই যুবক ছাড়া পাওয়ায় আইনজীবীদের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে পকসো-র মতো কঠোর আইনের অপব্যবহার হওয়ার বিষয়টিই কি এতে ফের সামনে এল? যেমনটা এক সময়ে হতো ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৮-এ ধারায় বধূ নির্যাতনের অভিযোগের ক্ষেত্রে?
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট লিভ-ইন পার্টনার এবং বয়ফ্রেন্ড ও গার্লফ্রেন্ড প্রসঙ্গে আইন সংশোধনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছে। এর পাশাপাশি, পকসো মামলায় মে মাসেই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি (এখন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) অভয় এস ওকা-র বেঞ্চ নজিরবিহীন ভাবে এ রাজ্যেরই এক অভিযুক্তকে জামিন দিয়েছে। সেখানে পকসো-তে অভিযুক্তকে ধর্ষিতা বিয়ে করে নিজের ও সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন।
নাবালিকা অবস্থায় তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। সেই সময়ে পরিবার মুখ ফিরিয়ে নেয়, সমাজ থেকে সরকার এমনকী বিচার ব্যবস্থাও ধর্ষিতা নাবালিকাকে সঠিক দিশা দেখায়নি— এমনটাই ছিল শীর্ষ আদালতের পর্যবেক্ষণ। তার আগে ওই অভিযুক্ত সম্পর্কে কলকাতা হাইকোর্ট কিছু বিতর্কিত মন্তব্য করায় শীর্ষ আদালতই স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করে।
আদালত সূত্রের খবর, বিধাননগরে পকসো মামলার অভিযোগকারিণী ওই ডিভোর্সি তরুণী সল্টলেকে একটি কফি পার্লার চালাতেন। কফি পার্লারের বিভিন্ন সামগ্রী সরবরাহের সূত্রে তাঁর আলাপ হয় ওই ব্যবসায়ী যুবকের সঙ্গে, যিনিও ডিভোর্সি।
যুবকের পারিবারিক ব্যবসা, যেখানে তাঁরা দুই ভাই মালিক। ২০১৯ সালে আলাপ হওয়ার পর দু’জনের মধ্যে ধীরে ধীরে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্ক আরও গভীর হলে দু’জনে একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন। কিন্তু পরে আর্থিক বিষয়কে কেন্দ্র করে দু’জনের বিবাদ শুরু হয় এবং শেষমেশ তা চরমে ওঠে।
এ দিন ওই যুবকের জামিন মামলায় তাঁর আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি জানান, অভিযুক্ত যুবকের পারিবারিক ব্যবসায় অভিযোগকারিণীর নজর দেওয়া থেকে দু’জনের গোলমালের সুত্রপাত। অশান্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, নিজের কন্যাসন্তানকে শ্লীলতাহানি করার অভিযোগ ওই তরুণী তাঁর লিভ-ইন পার্টনারের বিরুদ্ধে তোলায় পকসো-তে মামলা হয়। নিম্ন আদালতে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
কিন্তু সেখানে খোদ অভিযোগকারিণীই সাক্ষ্য দিতে যাচ্ছেন না। তাই, ধৃতের জামিন মঞ্জুর করা হোক বলে সওয়াল করেন এডুলজি। তার পর অভিযোগকারিণীকে বিচারপতি প্রশ্ন করেন, ‘আপনি আদালতে সাক্ষ্য দিতে যাচ্ছেন না কেন?’ তখন ওই তরুণী জানান, তাঁর ও সন্তানের নিরাপত্তার জন্য তাঁর বয়ফ্রেন্ডকে জামিন দেওয়া হোক।
ওই যুবকের জামিনের আবেদন মঞ্জুর করে হাইকোর্ট শর্ত দেয়, অভিযুক্ত বিধাননগর এলাকার বাইরে যেতে পারবেন না, মামলার কোনও নথি নষ্ট করতে পারবেন না এবং সাক্ষীদের উপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করতে পারবেন না।