এই সময়: একদিনে তিন মামলায় বিদ্ধ রাজ্য সরকার! তিনটি মামলাই ২০১৬–এর স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) নিয়োগ বাতিলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত।
সুপ্রিম-রায়ে চাকরিহারা শিক্ষাকর্মীদের মাসিক ভাতা দেওয়ার যে নির্দেশিকা সম্প্রতি জারি করেছে রাজ্য সরকার, তাকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। আবার তথাকথিত ‘টেন্টেড’ বা ‘অযোগ্য বলে চিহ্নিত’ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের বেতন ফেরানোর নির্দেশ কার্যকর না–হওয়ায় রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরের বেশ কয়েকজন আধিকারিকের বিরুদ্ধে নোটিস জারি করা হয়েছে।
তবে এ সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়ে মামলা দায়ের হয়েছে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগে রাজ্য সরকারের নয়া বিধি এবং এসএসসি–র বিজ্ঞপ্তিকে চ্যালেঞ্জ করে। নতুন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের হওয়া মামলায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ভাবেই উত্থাপন করা হয়েছে ২০১৬–এর পুরোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এবং সেই নিয়োগ প্যানেল খারিজ করে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রসঙ্গ।
ফলে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়াও আইনি জটে থমকে যাবে কি না, তা নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা। মঙ্গলবার কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়ের গ্রীষ্মাবকাশকালীন বেঞ্চে এই মামলা দায়েরের অনুমতি চাওয়া হয়। বিচারপতি চট্টোপাধ্যায় মামলা দায়েরের অনুমতি দিয়েছেন। আগামী ৫ জুন বিচারপতি রাজা বসুচৌধুরীর বেঞ্চে মামলার শুনানি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
তার কারণ, গত ২৯ মে রাজ্য সরকার শিক্ষক নিয়োগের যে নয়া বিধি ঘোষণা করেছিল, সেই বিধি মেনেই ৩০ মে এসএসসি নতুন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। মামলাকারীর অভিযোগ, নবম–দশম ও একাদশ–দ্বাদশের শিক্ষক পদে যে মোট ৩৫ হাজার ৭২৬ জনের নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে এসএসসি, তা অবৈধ।
২০১৬–এর বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে যে নিয়োগ হয়েছিল, তাতে ওয়েটিং প্যানেলে থাকা কয়েকজন প্রার্থীই এই মামলা দায়ের করেছেন। মামলাকারীর আইনজীবী ফিরদৌস শামিমের দাবি, ‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, ২০১৬ সালের নিয়োগ প্যানেল বাতিল হওয়ায় যে হেতু নতুন নিয়োগ হচ্ছে, তাই সেটা ২০১৬–এর বিধি অনুযায়ী করতে হবে।নতুন নিয়োগ পরীক্ষা নিতে হবে ২০১৬–এর চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে থেকেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেই নির্দেশ মানা হচ্ছে না।’
তাঁর আরও যুক্তি, ২০১৬–এর সব চাকরিপ্রার্থীর বয়সে ছাড়ের ক্ষেত্রেও শীর্ষ আদালতের নির্দেশ মানা হয়নি। তাই ২০২৫-এর নতুন বিজ্ঞপ্তি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরিপন্থী।
রাজ্য সরকার কী ভাবে ২০১৬ সালের নিয়োগ মামলায় ২০২৫–এর নতুন বিধি বলবৎ করতে চাইছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে মামলায়। এমনকী শিক্ষক নিয়োগের নম্বর বিভাজন পদ্ধতি নিয়েও আপত্তি জানানো হয়েছে।
নতুন বিধি অনুযায়ী, আবেদনকারীদের শিক্ষকতায় অভিজ্ঞতা বাবদ ১০ নম্বর বরাদ্দ হয়েছে। মামলাকারীর যুক্তি, ২০১৬–এর নিয়োগ দুর্নীতির জেরে যে সব চাকরিপ্রার্থী ‘বঞ্চিত’ হয়েছিলেন অথবা ওয়েটিং লিস্টে ছিলেন, তাঁদের শিক্ষকতা করার আগাম অভিজ্ঞতা নেই। তাই সেই ১০ নম্বর তাঁরা পাবেন না।
অর্থাৎ বাস্তবে কারও সিলেকশন প্রসেস ১০০ নম্বরে হবে, আবার কারও হবে ৯০ নম্বরের মধ্যে। এটা আইনের চোখে বিভাজন। ২০১৬ সালে শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য ৩৫ নম্বর দেওয়া হয়েছিল। এ বার তা ১০ নম্বর করা হয়েছে। সেটাও আইনি ভাবে বৈধ নয় বলে দাবি মামলাকারীর। নতুন বিধিতে লেকচার ডেমো বাবদ আরও ১০ নম্বর দেওয়ার সংস্থান রয়েছে।
মামলাকারীর যুক্তি, এর আগে ইন্টারভিউয়ের সময়েই পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছিল। নতুন এই বিধির ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পক্ষপাতিত্বের সম্ভাবনা বাড়বে। কারণ, লেকচার ডেমোর পারফরম্যান্সের বিষয়টি ‘সাবজেক্টিভ’ এবং তা পরীক্ষকের মনোভাবের উপরেই নির্ভর করবে।
মামলাকারীর তরফে আরও যুক্তি, নবম–দশম ও একাদশ–দ্বাদশে শিক্ষক এবং গ্রুপ–সি, গ্রুপ–ডি পদে শিক্ষাকর্মী— এই চার ক্যাটিগরিতে নিয়োগ হলেও রাজ্যের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২০১৬–এর ‘যোগ্য’রা যে কোনও একটি ক্যাটিগরিতে বয়সের ঊর্ধ্বসীমায় ছাড় পাবেন। কিন্তু কেউ যদি একাধিক ক্যাটিগরিতে পরীক্ষা দিতে চান, সেই সুবিধা তিনি পাবেন না কেন?
এই মামলাকারীকে সমর্থন করছেন ‘যোগ্য’ চাকরিহারা শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের একাংশ। তাঁদের দাবি, ২০১৬ সালের প্যানেল পুরোপুরি বাতিলের বিরোধিতায় তাঁরা প্রথম থেকেই সরব। তাঁরা রি–প্যানেলের দাবি করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, ‘যোগ্য-অযোগ্য’ আলাদা না করেই একসঙ্গে প্রায় ২৬ হাজার জনের চাকরি খারিজ করা যায় না।