সাংগঠনিক হিসাবে গোঁজামিল? নতুন করে ‘অঙ্ক কষতে’ গোটা রাজ্য নেতৃত্বকে মাঠে নামাচ্ছেন বিজেপি-র কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকরা
আনন্দবাজার | ০৪ জুন ২০২৫
প্রশ্ন তুলেছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। উত্তর খুঁজতে গিয়ে ‘গোঁজামিল’ টের পান পবন বনসল। সেই ‘গোঁজামিল’ মুছতে এবার ‘স্বচ্ছ’ অঙ্ক কষার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন মঙ্গল পাণ্ডে।
পোশাকি নাম ‘বুথ সশক্তিকরণ’। কোনও প্রকাশ্য বা সর্বজনীন কর্মসূচি নয়। বিজেপি-র অভ্যন্তরীণ কর্মসূচি। কিন্তু ‘নীলবাড়ি’ দখলের আসন্ন লড়াইয়ের প্রস্তুতিতে এই কর্মসূচি এখন বিজেপি নেতৃত্বের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু রাজ্য নেতৃত্ব নন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতিনিধিরাও সরাসরি ময়দানে নামছেন মণ্ডল, শক্তিকেন্দ্র এবং বুথের পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে। পরিস্থিতি এমনই যে, পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক (রাজনৈতিক) মঙ্গল নিজে মণ্ডল স্তরে গিয়ে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সাংগঠনিক নির্বাচন এবং বিভিন্ন স্তরের কমিটি গঠনের গতিবিধি পর্যালোচনা করতে গত ৭ মে একটি বৈঠক ডেকেছিলেন বিজেপি-র কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক (সাংগঠনিক) বনসল। সেই বৈঠকেই রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু সংগঠনের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিজেপি সূত্রের দাবি, শুভেন্দু ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, জেলা স্তর পর্যন্ত কোনও সমস্যা না থাকলেও তার নীচের স্তরের সংগঠনের চেহারা সম্পর্কে খাতায়-কলমে যে হিসাব দেখানো হচ্ছে, বাস্তবের সঙ্গে তার বিস্তর ফারাক। মণ্ডল, শক্তিকেন্দ্র (পাঁচটি বুথ) এবং বুথ স্তরে কমিটির চেহারা সম্পর্কে যে হিসাব লিখিত ভাবে জমা পড়েছে, বাস্তবের মাটিতে আদৌ তত কর্মীকে খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, কার্যত তা নিয়েই শুভেন্দু সংশয় প্রকাশ করেছিলেন।
এই ধরনের ‘সংশয়’ অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি-তে নতুন নয়। এর আগের সভাপতিদের জমানাতেও সংগঠনের আনুষ্ঠানিক চেহারা আর বাস্তব চেহারার মধ্যে বড়সড় ফারাক থাকার অভিযোগ উঠত। সে সব অভিযোগকে যথেষ্ট গুরুত্ব না দিলে ফল কী হয়, তা গত ১০ বছরের নির্বাচনী ফলাফলেই স্পষ্ট। তাই ৭ মে-র সাংগঠনিক বৈঠকে শুভেন্দু ওই বিষয়ে প্রশ্ন তোলার পরে আর ঝুঁকি নেননি বনসল। দিল্লি দফতরের কল সেন্টার থেকে বাংলার নানা প্রান্তের বিজেপি কর্মীদের ফোন করানো শুরু করেন তিনি। বিভিন্ন কমিটির যে সব তালিকা জমা পড়েছে, সেই সব তালিকা ধরে ধরে ফোন শুরু হয়। তাতেই ‘গোঁজামিল’ ধরা পড়ে বলে বিজেপি-র একাংশের দাবি।
সাংগঠনিক কাঠামোয় এই ‘গোঁজামিল’ বহাল রেখে নির্বাচনে যেতে চান না বনসল-পাণ্ডেরা। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগেই তাঁরা বাংলার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। কিন্তু খাতায়-কলমে পাওয়া হিসাবের ভিত্তিতেই নির্বাচনী রণকৌশল সাজিয়েছিলেন। তার ভিত্তিতেই বাংলায় বিজেপি-র সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে দিল্লিকে রিপোর্ট দিয়েছিলেন। কিন্তু ২০২৪ সালের নির্বাচনী ফলাফল বনসল-পাণ্ডেদের বুঝিয়ে দিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-র সংগঠনের যে লিখিত হিসাব হাতে পাওয়া যায়, তার ভিত্তিতে নির্বাচনে যাওয়া এবং নির্বাচনী প্রত্যাশা তৈরি করা অনুচিত। তাই তাঁরা হিসাব নতুন করে খতিয়ে দেখছেন।
৪ জুন, অর্থাৎ বুধবার থেকেই শুরু হয়ে যাচ্ছে সেই কাজ। তিন দিন ধরে জেলায় জেলায় গিয়ে মণ্ডল স্তরের সাংগঠনিক পরিস্থিতি খতিয়ে দেখবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। জেলা নেতৃত্বকে সঙ্গে রেখে সব মণ্ডল কমিটিকে ডেকে পাঠানো হবে। কমিটির যে তালিকা জমা পড়েছে, তার সঙ্গে মণ্ডল কমিটির চেহারা মিলছে কি না, খতিয়ে দেখা হবে। শক্তিকেন্দ্র স্তরের সমীক্ষা শুরু হবে ৭ জুন থেকে। সপ্তাহখানেক বা তারও বেশি সময় ধরে চলবে সেই ধাপের সাংগঠনিক সমীক্ষা। অর্থাৎ মণ্ডলে মণ্ডলে গিয়ে শক্তিকেন্দ্র স্তরের কর্মীদের ডেকে পাঠিয়ে সাংগঠনিক পরিস্থিতি বুঝে নেওয়া হবে। তার পরে আসবে বুথে বুথে পৌঁছে কর্মী গোনার কাজ।
জেলা স্তরে যাঁরা বৈঠক করতে যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে কেন্দ্রীয় সহকারী পর্যবেক্ষক (রাজনৈতিক) অমিত মালবীয়ও থাকছেন বলে বিজেপি সূত্রের খবর। আর মালবীয়ের মাথার উপরে থাকা পাণ্ডে মণ্ডল স্তরে গিয়ে বেশ কিছু বৈঠক করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন বলে খবর। পাণ্ডে যে রাজ্যের মন্ত্রী, সেই বিহারে ভোটের দামামা বেজে গিয়েছে আগেই। নিজের নির্বাচন ঘিরে তাঁর ব্যস্ততা তুঙ্গে। কিন্তু তার মাঝেও টানা তিন-চার দিন পশ্চিমবঙ্গে থেকে বেশ কিছু মণ্ডলে বৈঠক করে শক্তিকেন্দ্র স্তরের পরিস্থিতি তিনি নিজের চোখে দেখতে চাইছেন বলে বিজেপি সূত্রের দাবি।
তিনটি ধাপে বিজেপি সংগঠনের এই ‘গোঁজামিল’ মোছার রণকৌশল সাজিয়েছে। প্রথম ধাপে জেলা, মণ্ডল, শক্তিকেন্দ্র এবং বুথ স্তরে সরাসরি পৌঁছে সংগঠনের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখা হবে। এবং তার ভিত্তিতে প্রকৃত হিসাব দিল্লির সামনে তুলে ধরা হবে। এই সমীক্ষার মাধ্যমে যে সব এলাকায় সাংগঠনিক কাঠামোয় অসম্পূর্ণতা ধরা পড়বে, দ্বিতীয় ধাপে সেই সব অসম্পূর্ণতা মেটানোর কাজ হবে। সর্বত্র সে কাজ হয়ে যাওয়ার পরে তৃতীয় ধাপে হবে ‘শক্তিবৃদ্ধি’র চেষ্টা। অর্থাৎ, দু’টি ধাপ পেরোনোর পরেও যে সব এলাকায় সংগঠন উল্লেখযোগ্য ভাবে দুর্বল থেকে যাবে, সেই সব এলাকায় অন্য কোনও উপায়ে শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা হবে।
পাণ্ডে বা মালবীয় ছাড়া ৪ থেকে ৭ জুন কোন কোন নেতা জেলায় জেলায় যাবেন, সেই তালিকা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে যে, ‘বুথ সশক্তিকরণে’র এই কর্মসূচিকে বিজেপি কতটা গুরুত্ব দিয়েছে। রাজ্য বিজেপি-র দুই সংগঠন সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তী এবং সতীশ ঢোন্ড সেই তালিকার শীর্ষে রয়েছেন। রয়েছেন পাঁচ সাধারণ সম্পাদক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়, লকেট চট্টোপাধ্যায়, দীপক বর্মণ, অগ্নিমিত্রা পাল, জ্যোতির্ময় মাহাতো। রয়েছেন দুই সহ-সভাপতি রথীন্দ্রনাথ বসু এবং খগেন মুর্মু। রয়েছেন বিরোধী দলের মুখ্য সচেতক শঙ্কর ঘোষ এবং তিন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক, দেবশ্রী চৌধুরী এবং সুভাষ সরকার। অর্থাৎ, শুধু রাজ্য সভাপতি এবং বিরোধী দলনেতা ছাড়া রাজ্য বিজেপির প্রথম সারির বাকি সব নেতা তিন দিনের জন্য নেমে পড়ছেন সাংগঠনিক হিসেবের ‘গোঁজামিল’ চিহ্নিত করার অভিযানে। পরের দফায় এঁদেরই অনেকে মণ্ডল বা তার নীচের স্তরে গিয়ে বৈঠক করবেন।
রাজ্যে বুথের সংখ্যা কমবেশি ৮০ হাজার। তার মধ্যে প্রায় ১৪ হাজার বুথে ৯০ শতাংশ বা তারও বেশি ভোটার মুসলিম। সে সব এলাকায় বুথ কমিটি গঠন করার কথা বিজেপি ভাবছেই না। কিন্তু তার বাইরেও প্রায় ৯,০০০ বুথ রয়েছে, যেখানে ‘সন্ত্রাসের আবহ’ বিজেপি-র বুথ কমিটি তৈরিতে প্রধান বাধা বলে বিজেপি সূত্রের দাবি। বাকি ৫৭ হাজার বুথের সর্বত্র যাতে বিজেপি-র পূর্ণাঙ্গ বুথ কমিটি থাকে, বনসল-পাণ্ডেরা তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন। সেই লক্ষ্য মোটামুটি ছুঁয়ে ফেলা গেলে ‘সন্ত্রাসকবলিত’ বুথেও ‘শক্তিবৃদ্ধি’র দিকে নজর দেওয়া হবে বলে বিজেপি সূত্রের খবর।