ফোনে কথা রাহুল এবং অভিষেকের, ইঙ্গিত কি অন্য অক্ষের?
আনন্দবাজার | ০৪ জুন ২০২৫
পহেলগাম হামলা এবং ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের প্রেক্ষাপটে সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা নিয়ে লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী সম্প্রতি সরাসরি ফোনে কথা বলেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
রাজনৈতিক সূত্রে আজ জানা গিয়েছে, সরকারের সর্বদলীয় সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে অভিষেকের বিদেশ সফরের সময় রাহুল নিজে কথা বলেন বিষয়টি নিয়ে। প্রধানমন্ত্রীকে এই দাবিতে যে চিঠিটি দেওয়া হবে, সেখানে একই পাতায় রাহুল ও অভিষেকের সই। আজ সন্ধ্যা ছ’টার সময়ে ডেরেক ও’ব্রায়েন যান রাজাজি মার্গে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের দফতরে। সেখানে তাঁরা দু’জনে মেল করে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে চিঠিটি পাঠিয়ে দেন। সাম্প্রতিক অতীতে কংগ্রেস এবং তৃণমূলকে এতটা ঘনিষ্ঠতায় দেখা যায়নি নয়াদিল্লিতে। বিষয়টি ভোটমুখী পশ্চিমবঙ্গে কিছু রাজনৈতিক সম্ভাবনা উস্কে দিয়েছে বলে আপাতত মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। এই ঘনিষ্ঠতার জেরে রাজ্যের ভোটে তৃণমূল এবং কংগ্রেসের মধ্যে জোট সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে কি না, সে প্রশ্নের জবাবে দু’দলের নেতারাই বলছেন, এখনই এ নিয়ে বলার সময় আসেনি।
এটা ঠিকই যে অভিষেকের পাশাপাশি রাহুল কথা বলেছেন ডিএমকে-র টি আর বালু, এসপি-র অখিলেশ যাদব, শিবসেনার (উদ্ধবপন্থী) আদিত্য ঠাকরের সঙ্গেও। নবীন প্রজন্মের শীর্ষ নেতাদের (বালু বাদে) এই দৌত্যের পাশাপাশি তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েন, কংগ্রেসের কে সি বেণুগোপালরা বারবার নিজেদের মধ্যে আদানপ্রদান করেছেন প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠির বয়ান, তাতে সবাইকে সই করানোর, যাঁরা বাইরে রয়েছেন তাঁদের কাছ থেকে ডিজিটাল সই আনানোর বিষয়গুলি নিয়ে। গত সপ্তাহে এঁরা কথাবার্তা চালিয়ে গিয়েছেন।
রাজনৈতিক শিবির বলছে, অখিলেশ বা উদ্ধব-পুত্র আদিত্য অথবা ডিএমকে-র সঙ্গে রাহুল কথা বলবেন, এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। এঁদের প্রত্যেকেই সাম্প্রতিক অতীতে লোকসভা অথবা বিধানসভার ভোটে কংগ্রেসের জোট শরিক। কিন্তু তৃণমূলের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের ‘অ্যালার্জি’ ইন্ডিয়া মঞ্চ গঠনের আগে থেকেই ছিল এবং পরবর্তী সময়ে প্রতিটি সংসদীয় অধিবেশনে সেই দ্বৈরথ প্রকট হয়েছে। কিন্তু আজ যে চিঠিটি প্রধানমন্ত্রীকে ‘ইন্ডিয়া’র পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে, তার প্রথম পাতায় রাহুল-অভিষেকের একসঙ্গে সইয়ের বিষয়টি সংবাদমাধ্যমের সামনে বাড়তি উদ্যোগী হয়ে তুলে ধরেছেন তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন, কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য দীপেন্দ্র হুডা, কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র জয়রাম রমেশরা। আজ সন্ধ্যাবেলা জয়রাম প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়ার জন্য লেখা চিঠিটি প্রকাশ্যে আনেন। যেখানে রাহুল, অখিলেশ এবং অভিষেকের পরপর সই।
রাজনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, ঘটনাটি বিরল এবং বার্তাবাহী। কেন এটিকে বিরল বলে মনে করা হচ্ছে? সংশ্লিষ্ট মহলের বক্তব্য, গত দু’বছরে মাত্র দু’বার রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে কথা বলেছেন এই দুই নেতা। প্রথম বার ২০২৩ সালের ৩০ অগস্ট ভোরবেলা। সংবাদমাধ্যমের কাছে গোপন রেখে দিল্লিতে কাকভোরে রাহুলের বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিলেন অভিষেক। মুম্বইয়ে ইন্ডিয়া মঞ্চের বৈঠক শুরু হওয়ার ঠিক আগে মোদী-বিরোধী রণকৌশল এবং রাজ্যে সম্ভাব্য বোঝাপড়া নিয়ে একান্তে কথা বলেছিলেন তাঁরা। তখন সম্পর্ক ছিল মাখনের মতো মসৃণ, তার কিছুদিন আগেই বেঙ্গালুরুতে খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশংসা করেছিলেন রাহুলের। মঞ্চ থেকে তাঁকে, ‘আমাদের সবার প্রিয়’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
কিন্তু এর পর সম্পর্কের লেখচিত্র ক্রমশ নিম্নগামী থেকেছে। চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় তিক্ততা বেড়েছে প্রদেশ কংগ্রেস এবং তৃণমূলের, উভয় পক্ষের সমঝোতাও হয়নি। তবে চব্বিশের জুনে ফের একবার রাহুল আর অভিষেকের মধ্যে কথা হয়। লোকসভার স্পিকার নির্বাচনে কংগ্রেসের কে সুরেশকে প্রার্থী করার আগে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি বলে প্রথমে মনোনয়নে সই করেনি তৃণমূল। পরে রাহুল গান্ধী নিজে মমতা ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলে জটিলতা কাটান।
আজ যে চিঠিটিতে নিজেরা কথা বলে সই করলেন রাহুল-অভিষেক, মনে করা হচ্ছে তা একটি ইতিবাচক বিজেপি-বিরোধী পদক্ষেপের নিদর্শন— যা এর আগে সে ভাবে দেখা যায়নি এই দুই নেতার মধ্যে। প্রশ্ন উঠছে, পহেলগাম পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিজেপি নেতৃত্ব যেমন খোলাখুলি ভাবে মেরুকরণের রাজনীতিতে নেমেছেন, তাতে চোরা হিন্দুত্বের স্রোত বইছে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মতো ভোটমুখী বাংলাতেও। শুধুমাত্র সংখ্যালঘু ভোট যে তৃণমূলকে এ বার কাঙ্ক্ষিত আসনে পৌঁছে দিতে পারবে না এ কথা জানেন দলীয় নেতৃত্ব। আবার পহেলগামের পর যে রকম প্রশ্নাতীত ঐক্য মোদী সরকারকে দেখিয়েছে তৃণমূল, তাতে রাজ্যের মুসলিম মন কতটা খুশি, তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আগামী বছরের বিধানসভা ভোটে মুর্শিদাবাদ-মালদহের মতো জেলাগুলিতে কংগ্রেসের ভোটভিত্তির কথা তৃণমূল নেতৃত্বকে মনে রাখতে হচ্ছে কি না, সেই জল্পনা থাকছে।
তবে রাজনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, এখনই বাংলায় কংগ্রেস তৃণমূলের সঙ্গে জোট করবে কি না, তা বলার সময় আসেনি। কিন্তু রাহুল গান্ধী এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৌত্য নিঃসন্দেহে বার্তাবহ রাজ্যরাজনীতির নিরিখে।