মৌলি চক্রবর্তী, নিউ ইয়র্ক
আমার মা-বাবা চাকরি সূত্রে জলপাইগুড়িতে এসেছিলেন। বাবা ছিলেন জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালের চিকিৎসক। মা সেখানে কাজ করতেন নার্স হিসেবে। এই শহরেই আমার জন্ম হয়েছিল। আমার প্রথম স্মৃতিগুলো আমাদের বাড়ি অর্থাৎ হাসপাতাল কোয়ার্টার ঘিরে।
সেই চার দেওয়ালের মধ্যেই প্রথম উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়া এবং চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম। যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘শিশু নিকেতন’ থেকে। সেটাই ছিল আমার প্রথম স্কুল। পরে সুনীতিবালা সদর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে চলে যাই। আমার প্রথম জীবনের সেরা সময় ওটাই। এখনও মনে পড়ে প্রণম্য সব শিক্ষককে, তাঁদের নির্দেশেই বড় হওয়ার স্বপ্নকে লালন করতে পেরেছিলাম।
এখনকার পৃথিবী অনেকটাই মুঠোফোনে বন্দি। কিন্তু আমাদের পৃথিবী ছিল অনেকটা বড়। তার দু'টি বিন্দু ছিল খোলা মাঠ এবং জাদুকরী তিস্তা। আর পাঁচজনের মতো দুর্গাপুজো আমার কাছেও আনন্দ নিয়ে আসত। তবে কালীপুজো মনে একটা বিশেষ জায়গা দখল করত। কালীপুজোর সময়ে আমরা কাদা দিয়ে পাহাড় তৈরি করতাম, সেটিকে নানা ভাবে সাজিয়ে তুলতাম। এ ভাবেই আমাদের সরলতার উদ্যাপন হতো।
তার পরে আমার দুনিয়া ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে থাকে। ক্লাস টেনের পরে মা-বাবার বদলির কারণে আমরা কলকাতায় চলে যাই। ভর্তি হই প্রেসিডেন্সি কলেজে। ফিজিওলজি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। তার পরে ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস’ (এইমস)-এ যাই ফিজিওলজিতে মাস্টার্স করার জন্য।
তারপরে স্পেন সরকারের বৃত্তি পাই। সে দেশের ভ্যালেন্সিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োটেকনোলজি এবং বায়োমেডিসিন-এ পিএইচডি করি। গবেষণার বিষয় ছিল ‘নিউরো-ডিজেনারেশন’। এ নিয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও শুরু হয়, যা নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখতাম। ডাক্তার হইনি, তবে জীবনের নিজস্ব একটা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছি। আমি বিজ্ঞানী হয়েছি।
কলকাতা থেকে দিল্লি, বেঙ্গালুরু থেকে ইউরোপ, সিঙ্গাপুর থেকে নিউ ইয়র্ক-আমার যাত্রা মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত। ভারত ছেড়ে আসারও প্রায় এক দশক হয়ে গেল। এখন থাকি নিউ ইয়র্কে। কাজ করি একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে।
মার্কিন মুলুকের এই শহরটাকে আপন করে নিয়েছি। এখানে দুর্গাপুজো, দোল, কালীপুজো- সবেতেই আনন্দ করি। বিভিন্ন বাঙালি পরিবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। পুজোর সঙ্গে পিঠে-পার্বণও এখানে খুব জনপ্রিয়। উৎসবের সঙ্গী হিসেবে থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
আমি অবশ্য খুব বেশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারি না। তবে যখনই পারি, নেপথ্যে থেকে সাহায্য করি। এখানে বেশ কয়েকটি বাঙালি রেস্তোরাঁয় নানা রকম ঘরোয়া বাঙালি খাবার পাওয়া যায়। শুক্তো, কষা মাংস, লুচি, ছোলার ডাল, দই এবং আরও কিছু মিষ্টি-তালিকা অনেক লম্বা। এককথায়, মায়ের হাতের খাবার ছাড়া বাঙালি খাবার কমবেশি সব পাওয়া যায়।
জীবনের অনেক কিছুই এখন পাল্টে গিয়েছে। বদলায়নি শুধু জন্মস্থানের প্রতি আমার ভালোবাসা। যখনই বইমেলার কথা শুনি, তখনই জলপাইগুড়ি বইমেলায় চলে যাই। নিউ ইয়র্কের হাডসন নদী আমাকে তিস্তা নদীর মৃদু স্রোতের কথা মনে করিয়ে দেয়। এক কাপ চা ফিরিয়ে দেয় উত্তরবঙ্গের সবুজ চা বাগানের ছবি। আমার স্মৃতিতে, আমার ইন্দ্রিয়ের মধ্যে, আমার একেবারে মূলে বাস করে আমার একান্ত আপন জলপাইগুড়ি।
পরজন্মে আমি বিশ্বাস করি না। তবে যদি এমন কোনও জন্ম থাকে, যেখানে আমি আবার জন্ম নিতে চাইব, তা হলে সেটা হবে জলপাইগুড়ি। তখন আর তাকে ছেড়ে আমি এ জন্মের মতো অন্য কোথাও চলে যাব না। এ জন্ম তো বটেই, প্রতিটি জন্মে আমার আত্মার সঙ্গে নিবিড় বন্ধনে বাঁধা থাকবে ছোটবেলার সেই শহর। আমার আজন্মের জলপাইগুড়ি।
(অনুলিখন: সুদীপ দত্ত)