• উত্তর-দক্ষিণের সেতুবন্ধন গাছপাগল স্যরের
    এই সময় | ০৫ জুন ২০২৫
  • সঞ্জয় বিশ্বাস

    গাছের মধ্যে তিনি খুঁজে পান তাঁর মা-কে।

    মায়ের আঁচল তাঁর কাছে ছিল সবুজ পৃথিবী। তখন তিনি নেহাতই শিশু। সারা দিনের কাজের শেষে ছেলেকে নিয়ে স্লেটে মায়ের অআকখ লেখানো। পড়ার ফাঁকে মায়ের কাছেই জীবনের পাঠ নেওয়া। মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা-শাসনে একটু একটু করে জীবন এগোচ্ছিল মুর্শিবাদাদের নওদার অর্ধেন্দু বিশ্বাসের।

    একদিন সন্ধ্যায় তুলসী তলায় মায়ের প্রদীপ দেওয়া যখন হয়ে গিয়েছে, তখন ছেলে দেখল, অন্ধকারে জামরুল গাছতলায় মা একা দাঁড়িয়ে। ছেলে যেখানে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে লুকোচুরি খেলে, সেই গাছতলায় দাঁড়িয়ে মা কাঁদছে। পরদিন সকালে প্রকৃতিতে আলো ফুটল বটে, তবে ছেলের জীবনে অন্ধকার। মা-ই তো

    আর থাকল না। ঘরের কড়িকাঠে ঝুলছে মা, মাথাটা সামনের দিকে একটু ঝুঁকে। সামনে দাঁড়িয়ে ছেলের মনে হলো, মা যেন কিছু বলতে চাইছে। সেটা ১৯৯৮। তার পর থেকে মায়ের জন্য বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলেই সেই ছেলে ছুটে যেত গাছের কাছে, গাছকে জড়িয়ে ধরে কাঁদত।

    গাছ যে তাঁর মা!

    তার পর...। ২৭টা বছর কেটে গিয়েছে। অর্ধেন্দু বিশ্বাস আজও গাছকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। তবে আনন্দে। লোকে তাঁর নাম দিয়েছে ‘বিবেক বৃক্ষ’। বাইরে মানুষ, ভিতরে গাছ। মুর্শিদাবাদের বেগুনবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাঁকে ডাকে ‘গাছপাগল স্যর’ বলে। এখনও পর্যন্ত ১০ লক্ষেরও বেশি চারাগাছ লাগিয়েছেন অর্ধেন্দু।

    তাঁর এই বৃক্ষরোপণের মিশন মনে করিয়ে দেয় পুরুলিয়ার বান্দোয়ান লাগোয়া গাছেদের মুলুক, হ্যাঁ গাছেদেরই মুলুক 'ভালো পাহাড়'-এর কমল চক্রবর্তীকে। গত বছর অগস্টে প্রয়াত ওই সাহিত্যিক ও পরিবেশকর্মী পুরুলিয়ার রুক্ষ পাহাড়ে লক্ষাধিক গাছ রোপণ করে নতুন এক পৃথিবী তৈরি করেছিলেন। কমল চক্রবর্তী অন্যকে সম্বোধন করতেন, কখনও কখনও এমনিই হাঁক দিতেন 'জয় বৃক্ষনাথ' বলে।

    মুর্শিদাবাদের অর্ধেন্দু শিক্ষকতা করে পাওয়া তাঁর বেতনের অর্ধেক খরচ করে আগে নার্সারি থেকে গাছ কিনতেন। এখন তিনি নিজেই তৈরি করেছেন সিড ব্যাঙ্ক। নিজের স্কুল ছাড়াও জেলার আরও চারটি জায়গায়। বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, চারাগাছ উৎপাদন, বিতরণ- এ সবই তাঁর কাজ। জন্মদিন, অন্নপ্রাশন, বিয়ে-বৌভাত, রক্তদান শিবির বা বইমেলা, যে কোনও অনুষ্ঠানে অর্ধেন্দু উপহার দেন গাছের চারা।

    তবে কেবল নিজের জেলা মুর্শিদাবাদ নয়, ‘গাছপাগল স্যর’ উত্তরবঙ্গের পরিবেশকর্মীদের কাছে পাঠিয়ে দেন বীজ, গাছের চারা। গত ৮-৯ বছর ধরে কোচবিহার, মালদা ও উত্তর দিনাজপুর এবং শিলিগুড়ির সমাজকর্মীরা অর্ধেন্দুকে ফোন করলেই তিনি কখনও বাসের মাথায়, কখনও বা ক্যুরিয়র সার্ভিসের মাধ্যমে চারাগাছ পাঠিয়ে দেন। ‘বিবেক বৃক্ষ’র বিশ্বাস, ‘মানুষ পৃথিবীর শাসক নয়, অতিথি মাত্র। সবার উপরে প্রকৃতি সত্য।’

    পরিবেশ নিয়ে প্রায় এক যুগ ধরে করা মালদা শহরের টুবাই প্রামাণিকের সংগঠনের নাম ‘ম্যাজিক’। গাছের চারা হোক বা বীজ, যখনই প্রয়োজন হয় চেয়ে নেন অর্ধেন্দুর কাছে। টুবাই বলছেন, ‘আমরা যাঁরা পরিবেশ নিয়ে কাজ করি, তাঁরাই এখন সমাজবিরোধী হয়ে গিয়েছি।’ ব্যাপারটা কী রকম?

    টুবাইয়ের কথায়, ‘গাছ কাটার সময়ে বাধা দিতে যান, আপনি শত্রু হয়ে যাবেন। তাই, ভৌগোলিক ব্যবধান ঘুচিয়ে আমাদের সবার এই হাতে হাত ধরার উদ্যোগ। যে সেতুবন্ধনে অর্ধেন্দুদা খুব বড় ভূমিকা নিয়েছেন। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, বকুল, জাম, অর্জুন- যখন যে গাছের চারা বা বীজ চেয়েছি, অর্ধেন্দুদা সে সব নির্দ্বিধায় পাঠিয়ে দিয়েছেন।’

    শিলিগুড়ির গ্লোবাল গ্রিন ফোর্সের কনভেনর রামগোপাল বসাক অর্ধেন্দুকে কখনও সামনা-সামনি দেখেননি। কিন্তু লাল বকুলের বীজ হোক বা অর্জুন গাছের চারা, যখনই অর্ধেন্দুর কাছে চেয়েছেন, পেয়েছেন রামগোপাল।

    তাঁর কথায়, ‘অর্ধেন্দু বিশ্বাস হলেন সেতুবন্ধের কারিগর। ওঁর কাজ আমাকে অনুপ্রাণিত করে।’ আবার ‘কোচবিহার অনাসৃষ্টি’র সম্পাদক সুমন্ত সাহার বক্তব্য, ‘গত বছর কোচবিহার শহরে আড়াইশো নিম গাছ বসিয়েছি। বেশির ভাগ চারা এসেছে অর্ধেন্দুদার কাছ থেকে। সিড ব্যাঙ্কের জন্যও আমাদের সাহায্য করেছেন। উনি মুর্শিদাবাদের লোক, তাতে কী? ভৌগোলিক সীমা পার করে উত্তরবঙ্গের পরিবেশ বাঁচাতে তাঁর আগ্রহ কিছু কম নয়।’

    উত্তরবঙ্গের পরিবেশকর্মীদের এই সব বক্তব্য, তাঁকে নিয়ে এত চর্চা, জেলার ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করা- এ সবের একটাই ব্যাখ্যা নওদার অর্ধেন্দু বিশ্বাসের কাছে- ‘প্রকৃতির মধ্যে, গাছের মধ্যে আমি আমার হারানো মা-কে খুঁজে পাই।’

  • Link to this news (এই সময়)