এই সময়, কামারহাটি: ভাড়াটে চাই। কিন্তু যে-সে হলে চলবে না। গুলি চালাতে জানবে। চুরি-ছিনতাই করতে পারবে। ডাকাতিতে পাকা হতে হবে। বেশিদিন ভাড়া থাকলেও চলবে না। আসবে, হপ্তাখানেক থাকবে, মোটা টাকায় অস্ত্র ভাড়া নিয়ে ‘অপারেশন’ সেরে দিব্যি ভাড়া মিটিয়ে কেটে পড়বে।
ঠিক যেন সুকুমার রায়ের ‘সৎপাত্র’। চাহিদামতো মিলেও যেত এমন ‘ভাড়াটে’। পানিহাটি পুরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মৌলানা সেলিম রোডে তৃণমূল কর্মী নইম আনসারি ওরফে নেপালির বাড়ি থেকে অস্ত্র উদ্ধারের পরেই পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে এই চমকপ্রদ তথ্য।
তদন্তকারীদের দাবি, এলাকায় নিজের প্রভাব বিস্তার করতেই এমন ‘সৎপাত্র’–দের বাড়িভাড়া দিতেন ধৃত নেপালি। তাতে লাভ হতো ত্রিমুখী। প্রথমত, ভাড়ার নামে মোটা টাকা আসত। দ্বিতীয়ত, এমন ভাড়াটেদের নিজেই অস্ত্র ভাড়া দিতেন নেপালি। ফলে সেখান থেকেও কামাই হতো। তৃতীয়ত, গোটা এলাকা জেনে গিয়েছিল, দুষ্কৃতীদের সাম্রাজ্য চলে নেপালির ওই বাড়ি থেকে।
বাড়িতে দুষ্কৃতীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে বছরখানেক আগে এলাকায় কিছু লোকের হাতে আক্রান্তও হন নেপালি। কিন্তু কিছুদিন চুপ থাকার পরে ফের অস্ত্র এবং ঘর ভাড়া দেওয়ার কাজ শুরু করে দেন। ফলে নিজে কোনও অপরাধমূলক কাজে সরাসরি জড়িত না–থেকেও ‘প্রভাবশালী’ বাড়িওয়ালা হিসেবে পরিচিতি এবং ‘সমীহ’ পাচ্ছিলেন নেপালি।
গত সোমবার নেপালির বাড়িতে কামারহাটি ও খড়দহ থানার পুলিশের যৌথ অভিযানে উদ্ধার হয় ঝোলাভর্তি অস্ত্র। যার মধ্যে রয়েছে একটি ওয়ান শটার, একটি সিক্সার, তিনটি ইম্প্রোভাইজড রিভলভার এবং ১৩ রাউন্ড কার্তুজ। এর বাইরেও বাজেয়াপ্ত হয়েছে চপার, তলোয়ার, কুঠার।
ব্যারাকপুর পুলিশের দাবি, নেপালিকে দফায় দফায় জেরার পরে তিনি জানিয়েছেন, অস্ত্রগুলি তাঁর মৃত ভাই রাজার। সমাজবিরোধী কাজকর্মে যুক্ত থাকার অভিযোগ ছিল রাজার বিরুদ্ধেও। বছর ১৫ আগে বোমা বিস্ফোরণে মারা যায় রাজা। তার অস্ত্রগুলোই নাকি যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন নেপালি। তাই অনেক বছর পুরোনো হলেও প্রতিটা বন্দুকই ঝাঁ চকচকে, ব্যবহারের উপযোগী। শুধু সিক্সার বন্দুকটির একটি স্প্রিং খারাপ বলে সূত্রের দাবি।
পুলিশ যখন সোমবার নেপালির বাড়িতে হানা দেয়, তখন তিনি এলাকারই কোনও শাসক নেতার পার্টি অফিসে বসেছিলেন। খবর পাওয়ামাত্র তিনি গা–ঢাকা দেন। যদিও শেষরক্ষা হয়নি। সোমবারই গভীর রাতে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নেপালিকে।
পরে তাঁর পানিহাটির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনতলা বাড়িটির ৮টি ঘরে ভাড়াটিয়া বসিয়েছেন নেপালি। সেখানে যেমন পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকা লোকজন রয়েছেন, তেমনই ২–৩টি ঘর এমনও রয়েছে যেখানে একজন বা দু’জন সপ্তাহখানেকের জন্য এসে থাকে। আবার উধাও হয়ে যায়।
তারাই নেপালির থেকে অস্ত্র ভাড়া নিয়ে অপরাধমূলক কাজকর্ম করত বলে এলাকাবাসীর একাংশের অভিযোগ। যদিও ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার অজয় ঠাকুর বলছেন, ‘বাড়ি এবং অস্ত্র ভাড়া দেওয়ার বিষয়টির সত্যতা কতটা, আমরা খতিয়ে দেখছি। ধৃতকে দফায় দফায় জেরা করা হচ্ছে। ভাইয়ের পুরোনো অস্ত্র সে মজুত রাখার কথা বললেও তা কতটা ঠিক, সেটা বিভিন্ন দিক থেকে যাচাই করা হচ্ছে’।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রথম দিকে ছাঁট লোহার কারবারে যুক্ত থাকলেও গত কয়েক বছর গাড়ি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নেপালি। ফলে সন্দেহ করা হচ্ছে, শুধু ঘর বা অস্ত্র নয়, ‘অপারেশনে’ গাড়িও ভাড়া দিতেন নেপালি। সেই ‘ভাড়াটে’ বা দুষ্কৃতীরা কারা, এই রাজ্যের না ভিন্রাজ্যের, তারা কোন কোন অপরাধে যুক্ত — জেরায় এই সব তথ্য জানার চেষ্টা করছে পুলিশ।