• মহুয়ার পথে আলিফা, কর্পোরেট গ্ল্যামার ছেড়ে রাজনীতির মেঠো রাস্তায় লাল সাহেবের মেয়ে, ঘামে ভিজে গড়তে হবে ‘আস্থার সেতু’
    আনন্দবাজার | ০৬ জুন ২০২৫
  • কর্পোরেট বোর্ডরুমের শীতল হাওয়া ছেড়ে ঘর্মাক্ত মেঠোপথ! কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে এ বার পুরোদস্তুর রাজনীতির ময়দানে নাম লেখালেন নদিয়ার ‘লাল সাহেব’-এর মেয়ে আলিফা আহমেদ। বাবা নাসিরুদ্দিন আহমেদের মৃত্যুর পরে মেয়ে আলিফাকে নদিয়ার কালীগঞ্জ বিধানসভা থেকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। মঙ্গলবার প্রার্থী হিসাবে তাঁর নাম ঘোষণার পর সমাজমাধ্যমে অভিনন্দন জানিয়েছেন কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। কালীগঞ্জের তৃণমূল নেতৃত্ব বলছেন, মহুয়ার মতোই তাঁর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত কালীগঞ্জের দলীয় প্রার্থীর মিল অনেক। মহুয়ার মতো আলিফাও কর্পোরেট দুনিয়া থেকে রাজনীতি করতে আসা একজন নারী। আর রাজনীতির ময়দানে সফল হওয়ার ব্যাপারে সাংসদ মহুয়ার মতোই ‘দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’ তাঁদের এই তরুণ মুখ।

    রাজনীতিতে আসার আগে বিদেশি সংস্থার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার ছিলেন মহুয়া। থাকতেন বিদেশে। আলিফা পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি করেন একটি নামী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায়। মহুয়ার মতোই কর্পোরেট জীবনে সফল হওয়ার পরেও রাজনীতির ময়দানে এলেন আলিফা। তিনি জানেন, এই পথ মসৃণ নয়। তবে কঠিন রাস্তা পার হওয়ার ব্যাপারে প্রত্যয়ী নাসিরুদ্দিন-কন্যা। তাঁর দাবি, রাজনীতিতে তিনি খানিক নতুন হলেও রাজনীতি তাঁর কাছে নতুন নয়। আলিফার নিজের কথায়, ‘‘বাবা আমার রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা। হাতে ধরে রাজনীতি শিখিয়েছেন। বাবার দেখানো পথেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে চাই।’’

    বস্তুত, ২০১১ সালে নাসিরুদ্দিন যখন ভোটে লড়েন, তখন থেকেই বুথ ধরে ধরে নির্বাচন পরিচালনা করতেন মেয়ে আলিফা। ২০১৮ সালে নদিয়া জেলা পরিষদের তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন তিনি। তাই রাজনীতিতে আনকোরা নন বলেই দাবি তাঁর। আবার দল যে ‘এত তাড়াতাড়ি’ এমন গুরুদায়িত্ব দেবে সেটাও তিনি ভাবতে পারেননি। আলিফার কথায়, ‘‘আমি আমার দায়িত্ব নিয়ে সম্পূর্ণ সচেতন। তাই জয় নিয়েও আত্মবিশ্বাসী।’’

    তৃণমূল প্রার্থী আলিফার স্কুলজীবন কেটেছে মহুয়ার লোকসভা কেন্দ্র কৃষ্ণনগরে। হোলি ফ্যামিলি গার্লস স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করে বিটেক করেন দুর্গাপুর বেঙ্গল কলেজ থেকে। বর্তমানে টাটা কনসালটেন্সি এজেন্সির ‘প্রজেক্ট ম্যানেজার’ তিনি। পেশার কারণে অধিকাংশ সময় কলকাতায় থাকলেও দল যা দায়িত্ব দিয়েছে তা পালন করতে তিনি এখন থেকে কালীগঞ্জেই থাকবেন বলে জানিয়েছেন। এখন আর ‘প্রজেক্ট রিপোর্ট’ আর ‘ক্লায়েন্ট মিটিং’য়ের জন্য নয়, আলিফা প্রস্তুত হচ্ছেন রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে কালীগঞ্জ বিধানসভার প্রতিটি বাড়ির চৌকাঠে গিয়ে ভোটপ্রার্থনার জন্য।

    বর্ধমানের কেতুগ্রামের চিকিৎসক তাজিরুল ইসলামের সঙ্গে বছর দশেক আগে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন আলিফা। এই দম্পতির দুই পুত্রসন্তান। নাবালক ইহান ও আরিয়ানকে নিয়ে কলকাতাতেই থাকেন আলিফা। ভাই সাহিল আহমেদ প্রযুক্তিবিদ। তিনিও একটি সংস্থায় কর্মরত। নদিয়ায় ‘লাল সাহেব’ বলে খ্যাত ছিলেন আলিফা ও সাহিলের বাবা নাসিরুদ্দিন। একাধারে তিনি ছিলেন আইনজীবী। অন্য দিকে রাজনীতিবিদ। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে প্রথম বার বিধায়ক হন। মাঝে ২০১৬ সালে কংগ্রেস-সিপিএম জোটের প্রার্থী শেখ হাসানুজ্জামানের কাছে পরাজিত হন। পরের বার আবার ‘লাল সাহেব’কেই প্রার্থী করে তৃণমূল। জয়ী হন ২০২১ সালে। নাসিরউদ্দিন প্রয়াত হওয়ার পর তাঁর পরিবার এবং অনুগামীদের ইচ্ছা ছিল যে, আলিফাই ওই আসন থেকে ভোটে দাঁড়ান। ৬৫ বছরের আফরোজা বেগমও চাইছিলেন, স্বামীর ছেড়ে যাওয়া আসনটিতেই লড়াই করুক মেয়ে।

    তৃণমূল সূত্রে খবর, ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে আলিফার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা থাকলেও কর্পোরেট পেশাতেই মনোনিবেশ করেন তিনি। ধীরে ধীরে যোগাযোগ কমে আসছিল জন্মভিটের সঙ্গে। ভূমিকন্যাকে সেই যোগাযোগের সুযোগ ফিরিয়ে দিল তৃণমূল। ঘাসফুলের এক নেতার কথায়, ‘‘আলিফা অবগত যে, গ্রামের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা তাঁর কর্পোরেট চাকরির ড্যাশবোর্ডের সংখ্যা নয়, বরং কঠিন বাস্তবতা। কৃষকের সমস্যা থেকে মেয়েদের স্কুলছুটের হিসাব— এ সবের সমাধান শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অফিসে বসে নয়, মাঠে দাঁড়িয়ে করতে হবে তাঁকে। আমার বিশ্বাস লাল সাহেবের মেয়ে সেটা করে দেখাবেন।’’

    তৃণমূল নেতা জুলফিকর আলি এখানেই মহুয়ার সঙ্গে তুলনা টেনেছেন আলিফার। তিনি জানান, মহুয়ার সাফল্য দেখিয়ে দিয়েছে, কর্পোরেটের দক্ষতা রাজনীতির মাঠে কাজে লাগলে জনসেবার গতিপথই বদলে যায়। ওই তৃণমূল নেতা বলেন, ‘‘মহুয়া পথ দেখিয়েছেন, আলিফাকে এখন সেতু বানাতে হবে। কর্পোরেটের ‘এগ্‌জ়িকিউটিভ প্রেজেন্স’ নয়, গ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে তাঁকে।’’

    মহুয়ার পর নদিয়ার রাজনীতিতে আর এক কর্পোরেট রাজনীতিকের ভাগ্যপরীক্ষা আগামী ১৯ জুন।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)