• মারাং বুরুকে আঘাত নয়, হুঙ্কার ‘তিলাবনি পাহাড় বাঁচাও কমিটি’-র
    এই সময় | ০৬ জুন ২০২৫
  • প্রশান্ত পাল, পুরুলিয়া

    তাঁদের লড়াই গ্রামের পাহাড় বাঁচানো। হুড়া ব্লকের তিলাবনি পাহাড়-রক্ষার আন্দোলনে এই গ্রামগুলির মানুষ পথে নেমেছিলেন ২০১৯ সাল থেকে। এ লড়াই শুধু পাহাড়কে রক্ষা করাই নয়, তার সঙ্গে রয়েছে পরিবেশকে বাঁচানোর শপথও। তা নিয়ে বার বার প্রশাসনের দুয়ারে হত্যে দিয়ে মিলেছে উপেক্ষা। এ বার তাঁরা মরিয়া।

    শুরু হয়েছে আন্দোলন। প্রয়োজন পড়লে জেলে যেতেও কেউ পিছপা নন। হুড়ার তিলাবনি পাহাড় কেটে গ্রানাইট উত্তোলন প্রকল্প অবিলম্বে বাতিল করতে হবে, এই দাবিকে সামনে রেখেই এখানকার মানুষ টানা ছ’বছর ধরে পথে পড়ে রয়েছেন।

    এই পাহাড়ের দক্ষিণে তিলাবনি, উত্তরে পড়াশিবনা, পূর্বে লেদাবনা ও পশ্চিমে মাধবপুর গ্রাম। পাহাড়কে ঘিরে থাকা এই চার গ্রামের মানুষ সম্মিলিত ভাবে গড়ে তুলেছেন ‘তিলাবনি পাহাড় বাঁচাও কমিটি’।

    তাঁদের দাবি, কেন এই পাহাড় কেটে ফেলা হবে? বরং এ বিষয়ে প্রশাসন কেন উল্টো কথা বলে, তা নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা। জানাচ্ছেন, পাহাড়কে কেন রক্ষা করা উচিত, সে বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে প্রশাসনকে। কিন্তু তা শোনে কে?

    দিনের পর দিন লড়াই করতে করতে এই চার গ্রামের মানুষের মনও হয়ে উঠেছে ইস্পাতের মতো কঠিন। তাঁরা শুনিয়ে দিচ্ছেন, পাহাড় কাটতে দেওয়া হবে না।

    তদানীন্তন বাম আমলে এই পাহাড় কেটে গ্রানাইট উত্তোলনের বরাত পেয়েছিল এক সংস্থা। এলাকার মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদে সেই সংস্থা পিছু হঠেছিল। ২০১৯ সালে নতুন করে রাজ্য মাইনস অ্যান্ড মিনারেলস ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন অন্য এক সংস্থাকে একই ভাবে বরাত দেয় পাহাড় কাটার। সেই তথ্য সামনে আসতেই ফের প্রতিবাদ জানিয়ে পথে নেমেছেন এলাকার মানুষ। ফলে কাজ শুরুই হয়নি।

    পাহাড় কাটার প্রতিবাদ জানিয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দ্বারস্থ হওয়া ছাড়াও এলাকায় নানা ধরনের প্রতিবাদ আন্দোলনও হয়েছে। এই গ্রামগুলির মানুষের জীবন-জীবিকার স্বার্থে কেন পাহাড়টিকে রক্ষা করা প্রয়োজন, তা নিয়ে এলাকায় একাধিক সভাও হয়েছে।

    কমিটির বক্তব্য, মারাং বুরু গরাম ঠাকুরের উপরে কোনও ধরনের আঘাত করা চলবে না। এই পাহাড় আবহমান কাল ধরে এলাকার মানুষজনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

    এই পাহাড় এক দিকে যেমন পূজার্চনার স্থল, তেমনই তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে জীবিকা নির্বাহের প্রশ্ন। এলাকার মানুষের অভিযোগ, সরকারি মদতে মুনাফার স্বার্থে সেই পাহাড়কে কেটে ফেলার চক্রান্ত শুরু হয়েছে।

    তিলাবনি পাহাড় বাঁচাও কমিটির সম্পাদক স্বরূপ মাহাতোর মোবাইলের রিংটোনেও প্রকৃতিকে বাঁচানোর সঙ্গে গাছ লাগানোর যৌক্তিকতার স্লোগান। তিনি বলছেন, ‘এই পাহাড় এলাকার পরিচয় বহন করে। একবার তাকে কেটে ফেলা হলে নতুন করে আর একটি পাহাড় তৈরি হবে না। তা হলে তাকে কেন বিলুপ্ত করার চেষ্টা?’

    কমিটির আর এক সদস্য রাখহরি মাহাতো আবার ঝুমুর গান লিখে প্রতিবাদে নেমে পড়েছেন। তিনি বলছেন, ‘প্রকৃতি–রক্ষার আন্দোলনে থাকায় আমাদের আট জনকে জেলে যেতে হয়েছে।

    চাষাবাদ এবং পশুপালনের ক্ষেত্রে এই পাহাড়ের কত বড় ভূমিকা রয়েছে, কেউ তা নিয়ে ভাবছেন না। বৃষ্টি হলে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা জলে মেটে সকলের তৃষ্ণা। মাটির চরিত্রও হয় উর্বর।’

    এই আন্দোলনে কমিটির পাশে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ ও ব্রেক থ্রু সায়েন্স সোসাইটি নামে দু’টি সংগঠন। রয়েছেন সমাজের নানা স্তরের মানুষও। বিজ্ঞান মঞ্চের জেলা সম্পাদক নয়ন মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘এলাকার মানুষের প্রকৃতিকে রক্ষা করার এই আন্দোলনে ওঁদের পাশেই রয়েছি।’

    ব্রেক থ্রু সায়েন্স সোসাইটির জেলা সম্পাদক স্বদেশপ্রিয় মাহাতোর কথায়, ‘প্রকৃতির বিপন্নতাই এলাকার মানুষের আন্দোলনের মূল শক্তি। আমরা সর্বতো ভাবে ওঁদের সঙ্গে রয়েছি।’

  • Link to this news (এই সময়)