দিগন্ত মান্না, পাঁশকুড়া
‘গুড়কাদা’ আলাদা! গ্রামের আট থেকে আশি সে কথা জানেন সক্কলে। নারকেল হোক বা আম— তরতরিয়ে মগডালে ওঠায় ‘গুড়কাদার’ জুড়ি মেলা ভার। ভরদুপুরে নারকেল গাছে উঠে তিনি দিব্যি গলা ছেড়ে ধরতে পারেন, ‘এই সেই কৃষ্ণচূড়া…।’
তাই বলে বিবাহ-সংবাদের ধারাভাষ্য? শুক্রবার সেই কম্মটিও করে বসলেন বছর পঞ্চাশের অজয় জানা। এ বার নির্ঘাৎ হোঁচট খেলেন। ভাবছেন তো, অজয় কে? অজয় ‘গুড়কা’র ভালো নাম। মানে, ওই অফিশিয়াল নেম। তবে গ্রামের সবার কাছে তিনি এক এবং অদ্বিতীয় গুড়কাদা!
গুড়কাদার এ দিনের কাণ্ড দেখে অনেকেরই মনে পড়ে গিয়েছে ‘ধন্যি মেয়ে’ সিনেমার ‘নেড়া’র কথা। ১৯৭১ সালে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় মুক্তি পেয়েছিল ছবিটি। ‘নেড়া’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুখেন দাস।
নেড়া ফুটবল ম্যাচ চলাকালীন গাছে উঠে নাগাড়ে ধারাভাষ্য দিত। এ দিন গুড়কাদাও যেন নেড়া হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর কীর্তি দেখে গ্রামের অনেকেই হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘গুড়কাদা, তুমি ধন্যি লোক বটে!’
পূর্ব মেদিনীপুরের হরেকৃষ্ণপুর গ্রামের বিশেষ ভাবে সক্ষম বুলবুল সাউকে গ্রামের সবাই ভালবাসেন। কিন্তু বুলবুল বিয়ে করছেন, এটা জানা ছিল না কারও। এ দিন দুপুরগ্রামের শিব-শীতলা মন্দিরের জামগাছে উঠে গুড়কাদা ঘোষণা করলেন, ‘আজ শীতলা মন্দিরে বিয়ে করবে আমাদের সবার প্রিয় বুলবুল।’ ব্যস! মুহূর্তে ভরে গেল শিব-শীতলা মন্দির চত্বর ‘মাড়তলা’।
কেউ সাজিয়ে দিলেন কনেকে। কেউ আশীর্বাদ করলেন নবদম্পতিকে। চল্লিশের দোরগোড়ায় এসে বুলবুলের একটা ‘হিল্লে’ হওয়ায় খুশি গ্রামের মানুষজন। খুশি বুলবুলের মা-বাবাও। বিয়ে শেষে তাঁরা গ্রামের সবাইকে মিষ্টি আর আইসক্রিম খাইয়েছেন।
মাইশোরা গ্রাম পঞ্চায়েতের হরেকৃষ্ণপুরের বাসিন্দা বিষ্ণুপদ সাউ এবং বাসন্তী সাউ দু’জনেই হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন। বেশ কয়েক বছর দু’জনেই অবসর নিয়েছেন। শিক্ষক দম্পতির তিন ছেলেমেয়েই বিশেষ ভাবে সক্ষম।
তাঁদের চিকিৎসার কোনও ত্রুটি রাখেননি তাঁরা। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। তাঁদের জন্য দোতলা পাকা বাড়ি করেছেন। জমি-জায়গাওনেহাত কম নেই। কিন্তু তাঁদের অবর্তমানে ছেলেমেয়েদের দেখবে কে?
বড় ছেলে বুলবুলের বয়স সাঁইত্রিশ বছর। ছেলের জন্য পাত্রীর খোঁজ শুরু করেন বিষ্ণুপদ এবং বাসন্তী। পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরার ত্রিলোচনপুরের বছর তিরিশের জ্যোৎস্না মান্নার খোঁজ পান। পাত্রীও বিশেষ ভাবে সক্ষম। বাবা-মা নেই। দাদাদের সংসারে থাকেন।
জয়দেব ঘোষ নামে এক ব্যবসায়ী জ্যোৎস্নার দাদাদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান। বিয়েতে রাজি হন জ্যোৎস্না ও বুলবুল। কয়েক দিন আগে ঘটকের সঙ্গে এসে হবু স্বামীর বাড়িও ঘুরে যান জ্যোৎস্না।
গ্রামের বাসিন্দা কাকলি মান্না বলেন, ‘বুলবুলকে সেই ছোট থেকে দেখছি। খুব ভালো মনের ছেলে। গেছো গুড়কাদার গলায় খবর পেয়েই মন্দিরে ছুটে এসেছি। খুব আনন্দ পেয়েছি।’
সকাল থেকে বুলবুলের বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত ছিলেন বাসুদেব পাত্র। তিনি বলেন, ‘ওই পরিবারে অর্থের অভাব নেই। অভাব দেখাশোনা করার লোকের। বুলবুলের বিয়েতে আমরা খুব খুশি হয়েছি।’
নববধূকে নিয়ে টোটোয় উঠতে উঠতে লাজুক হেসে বুলবুল বলেন, ‘বিয়েটা দাদা করেই ফেললাম।’ আর জ্যোৎস্নার কথায়, ‘আমরা দু’জনেই তো একইরকম। সেই কারণেই বুঝি উপরওয়ালা মিলিয়ে দিল। নিজের সংসার পেলাম।’
টানা প্রচারে গলা ভেঙেছে গুড়কাদার। তার উপরে বিয়ে চলাকালীন গোটা পাঁচেক নীল সুতোর বিড়িও শেষ করেছেন। সবকিছু ভালোয় ভালোয় মিটে যাওয়ার পরে গুড়কাদার প্রতিক্রিয়া, ‘গলা ভেঙেছে তো কী হয়েছে, মনটা যে জুড়িয়ে গেল। এ কী কম পাওনা!’