• কুকথায় চ্যালেঞ্জের মুখে বিচারের লাইভ স্ট্রিমিং
    এই সময় | ০৭ জুন ২০২৫
  • এই সময়: কয়েক মাস আগের ঘটনা। একটি নির্দেশ কার্যকরী না করার অভিযোগে মামলায় এক গ্রাম পঞ্চায়েতের মহিলা প্রধানকে সশরীরে হাজির হতে হয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টের এজলাসে। বিচারপতি প্রায় ধমকের সুরেই তাঁর কৈফিয়ৎ চান।

    মহিলা প্রধানকে দেখা যায় আমতা আমতা করছেন। ইউটিউবে সেই শুনানি-পর্বের লাইভ স্ট্রিমিংয়ের কেটে নেওয়া নির্দিষ্ট অংশ অচিরেই ছড়িয়ে পড়ে মোবাইলে মোবাইলে। সঙ্গে বাছাই শব্দে ‘কমেন্ট’। তার কোনওটা বিচারপতির উদ্দেশে, কোনটায় তির সেই প্রধানের দিকে।

    আবার গত ৩ জুন বিচারপতি পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়ের গ্রীষ্মাবকাশকালীন বেঞ্চে এক সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারের জামিন-আর্জির শুনানিও নিমেষে ভাইরাল হয় ইউটিউবে লাইভ স্ট্রিমিংয়ের সূত্রেই।

    বিচারপতি নানা প্রশ্ন করছিলেন ধৃতের আইনজীবীকে। কিছু মন্তব্যও করেন। ইউটিউব লাইভে সেই শুনানি চলাকালীনই কমেন্টের ফোয়ারা ছুটতে শুরু করে। যার সিংহভাগই বিচারপতিকে নিশানা করে। জামিনের আবেদন তিনি খারিজ করে দেওয়ার পরে ইউটিউব ছেড়ে এক্স হ্যান্ডলে বিচারপতিকে টার্গেট করে শুরু হয় কদর্য ভাষায় আক্রমণ।

    স্বচ্ছতার স্বার্থে এবং সাধারণের সুবিধার্থে সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্টের বিচার-প্রক্রিয়ার লাইভ স্ট্রিমিং শুরু হয়েছে করোনাকালের পর থেকেই। আর সেই লাইভ স্ট্রিমিংয়ের সূত্রে ইদানীং রোজই সোশ্যাল মিডিয়ায় এক শ্রেণির নাগরিকের কাটাছেঁড়া, টিপ্পনীর মুখে পড়ছে বিচারব্যবস্থা।

    বিচারপতি পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়কে যে ভাবে ইউটিউবের কমেন্ট বক্সে এবং অন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রাণে মারার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে, তাতে বিচারবিভাগের আধিকারিকরা মনে করছেন, এ বার অন্তত কিছু পদক্ষেপ প্রয়োজন।

    হাইকোর্ট সূত্রে খবর, ছুটির পরে সোমবার কোর্ট খুললেই এ ব্যাপারে বৈঠক ডাকা হবে। সাধারণ ভাবে ইউটিউবে হাইকোর্টে কোনও মামলার শুনানির হাজারখানেক থেকে হাজার দু’য়েক ভিউ হয়।

    গত ৩ জুন বিচারপতি চট্টোপাধ্যায়ের এজলাসের ওই শুনানি দেখেছেন দশ হাজারেরও বেশি লোক। লাইভের সঙ্গেই শুরু হয়েছিল কমেন্টের বন্যা। ভিউয়ারের সংখ্যা দেখিয়ে হাইকোর্টের আইটি সেলের এক অফিসারের বক্তব্য, ‘কোনও প্রভাবশালী বা ইনফ্লুয়েন্সারের মামলা হলে যদি এত ভিউয়ার হয় আর তাঁরা কুমন্তব্য করতে থাকেন, বিচারপতিকে হুমকি দেন—তা হলে আগামী দিনে পুরো বিষয়টি নিয়েই ভাবতে হবে।’

    তবে এক্স হ্যান্ডলে একপক্ষ যখন বিচারপতি সম্পর্কে কুমন্তব্য করে প্রাণে মারার হুমকি দিচ্ছিলেন, তখন কেউ কেউ সে–সব মন্তব্যের প্রতি কলকাতা ও রাজ্য পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পদক্ষেপেরও অনুরোধ করেন।

    কিন্তু এখনও পর্যন্ত পুলিশ কোনও পদক্ষেপ করেছে বা কুমন্তব্যকারীদের নামে অভিযোগ দায়ের করেছে বলে জানা যায়নি। বিচারবিভাগের এক অফিসার বলেন, ‘পুলিশ কখনও কখনও কোনও কোনও ব্যাপারে অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে। যেখানে বিচারব্যবস্থাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, সেখানে পুলিশের অবশ্যই এক্তিয়ার আছে স্বতঃপ্রণোদিত অভিযোগ দায়ের করার।’

    সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশে সব হাইকোর্টে শুনানির লাইভ স্ট্রিমিংয়ের উদ্যোগ শুরু হলেও এ নিয়ে অবশ্য তেমন বাধ্যবাধকতা নেই। কলকাতা হাইকোর্টের বহু বিচারপতি তাই লাইভ স্ট্রিমিংয়ের পরিকাঠামো থাকলেও তা ব্যবহার করেন না।

    এই নিয়ে এজলাসে কোনও কোনও বিচারপতি স্পষ্টই জানিয়েছেন, শুনানি চলাকালীন নানা প্রশ্ন করতে হয়, নানা মন্তব্য করা হয়। যার সঙ্গে মূল বিচার বা রায়ের যোগ সব সময়ে নাও থাকতে পারে।

    কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষীমহল নিজেদের মতো করে শুনানির অংশবিশেষ কেটে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। নানা মন্তব্য চলতে থাকে। সেটা অভিপ্রেত নয়। এখন বিচারপতি চট্টোপাধ্যায়ের ঘটনার পরে সব পক্ষই একমত—এ বার একটা কিছু করা উচিত।

    কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি দেবাশিস করগুপ্তর বক্তব্য, ‘স্বচ্ছতার স্বার্থে শুনানির লাইভ স্ট্রিমিং করা হয়। এটা ভালো দিক। কিন্তু তার যদি মিস ইউজ় হয় বা বিচার-প্রক্রিয়া দেখে যদি কেউ বিচারপতিকে প্রাণে মারার হুমকি দেয়, তা হলে তাদের বিরুদ্ধে ক্রিমিন্যাল কনটেম্পট মামলা দায়েরের সুযোগ অবশ্যই রয়েছে। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমন বিষয়গুলিকে ইগনোরই করতে হয়। তবে কিছু সময় আসে যখন কড়া পদক্ষেপ করা প্রয়োজন প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই।’

  • Link to this news (এই সময়)