আবছা আলোয় মৃদু পদক্ষেপ নার্সের, হয় প্রসূতির সঙ্গে গল্প, অ্যালুমিনিয়াম শিটের ঘর থেকে শোনা যায় নবজাতকের কান্না...
আজকাল | ০৭ জুন ২০২৫
বিভাস ভট্টাচার্য
ছবিটার সঙ্গে সংজ্ঞাটাই পাল্টে গেছে। লেবার রুম বা প্রসবের ঘরের। নেই আশেপাশে কোনও ভিড়। নেই কোনও চিৎকার। ঘরের আলোটাও বেশ আরামদায়ক। প্রয়োজনে যেখানে প্রসূতি মায়ের পছন্দের সঙ্গীতও বাজানো যেতে পারে। নামটা লেবার রুম হলেও ভিতরের পরিবেশটা যেন একটা বিশ্রাম নেওয়ার ঘর।
না, এটা কোনও ঝাঁ চকচকে বেসরকারি হাসপাতালের দৃশ্য নয়। কোনও সরকারি বা বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের লেবার রুমও নয়। ছবিটা কলকাতা সংলগ্ন দক্ষিণ ২৪ পরগণা ক্যানিংয়ের একটি মেটারনাল অ্যান্ড চাইল্ড হেল্থ হাব বা এমসিএইচ-এর। যেখানে রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তরের সহযোগিতায় এবং দেশের প্রাক্তন ন্যাশানাল অ্যাডভাইজার অফ চাইল্ড হেল্থ এবং যোধপুর এআইএমএস-এর শিশুরোগ বিভাগের অধ্যাপক ও প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান বর্তমানে স্বাস্থ্য ভবনে কর্মরত ডাঃ অরুণ সিংয়ের পরামর্শে তৈরি একটি লেবার রুম। যাকে 'পাইলট প্রজেক্ট' হিসেবেই বলছেন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক বা সিএমওএইচ ডাঃ মুক্তিসাধন মাইতি। যেখানে সাধারণ বা 'নর্মাল ডেলিভারি' হয়।
এই বিশেষ লেবার রুম প্রসঙ্গে ডাঃ অরুণ সিং বলেন, 'আমাদের শিক্ষাটা নিতে হবে প্রকৃতির থেকে। সন্তান প্রসবের সময় প্রসূতিকে আমরা যতটা মানসিক চাপ থেকে মুক্ত রাখতে পারব ততটাই তাঁর পক্ষে প্রসবের কাজটা সহজ হয়ে যাবে। বিষয়টি একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত। এই 'ব্যক্তিগত'র উদাহরণ যদি আমরা প্রকৃতির থেকে নিতে পারি তবে তার অজস্র উদাহরণ আছে। যেমন দুটি গর্ভবতী গরু কখনও পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তাদের শাবক প্রসব করবে না বা এককথায় বলতে গেলে সন্তান প্রসবের সময় যে কোনও পশু নিজেকে বাকিদের থেকে আলাদা করে নেয়।'
তাঁর কথায়, 'সাধারণত সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে লেবার রুমের মধ্যে পাশাপাশি অনেকগুলি শয্যা থাকে। সেখানে পাশাপাশি মায়েরা সন্তান প্রসব করেন। রুমের মধ্যে আলো জ্বলে এবং মায়েদের কানে নানারকম শব্দ আসে যা মায়েরা পছন্দ করতে নাও পারেন। যার ফলে তাঁদের মস্তিষ্কের মেলাটোনিন হর্মোন নিঃস্বরণে বাধা তৈরি করতে পারে। যার জন্য অক্সিটোসিন হর্মোনও ঠিকঠাক ক্ষরণ হবে না। প্রসবের সময় যার জন্য তৈরি হয় সমস্যা। যে কারণে ফরসেপ ব্যবহার করে বা সিজার করে বাচ্চা বের করে আনতে হয়। দক্ষিণ ২৪ পরগণার ওই লেবার রুমে এই বিষয়গুলির উপর জোর দেওয়া হয়েছে।'
নতুন এই ব্যবস্থা প্রসঙ্গে দক্ষিণ ২৪ পরগণার সিএমওএইচ ডাঃ মুক্তিসাধন মাইতি বলেন, 'এই ব্যবস্থায় অ্যালুমিনিয়ামের পাত দিয়ে আলাদা আলাদা কক্ষ তৈরি করে প্রতি প্রসূতিকে আরেকজনের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। যার জন্য তাঁকে কোনও অবাঞ্ছিত শব্দ শুনতে বা কোনো অবাঞ্ছিত আলো দেখতে হচ্ছে না। ঘরের আলোটা হাল্কা হওয়ার জন্য প্রসূতির মস্তিষ্কে মেলাটোনিন সক্রিয় হয়ে অক্সিটোসিন হর্মোন নিঃস্বরণ করতে সহায়তা করছে এবং যার জন্য মা তাঁর সন্তানকে ধীরে ধীরে বাইরে বের করে আনতে পারছেন। এর জন্য তাঁকে কোনও জোরাজুরি করতে হচ্ছে না। ২০২২ সালে এটার কাজ শুরু হয়েছিল। যেটার ফল আমরা ২০২৫ সালে পাচ্ছি।'
রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রসূতি মায়েদের সন্তান প্রসবের সময় লেবার রুমে স্বাচ্ছন্দ্য দিতে দেশজুড়ে চালু হয়েছে 'লক্ষ্য' প্রকল্প। এবিষয়ে যে নির্দেশিকা আছে সেখানে লেবার রুমে পর্দার পার্টিশনের মতো বিষয়টি আছে। কিন্তু পর্দা এক মায়ের ব্যাথার চিৎকার অন্য মায়ের কানে পৌঁছয়। যার জন্য মায়ের মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে তিনি প্রসব বন্ধ করে দিতে পারেন। ফলাফল 'ফরসেপ' বা 'সিজারিয়ান সেকশন'-এর ব্যবহার বৃদ্ধি। এরই সমাধান হিসেবে এই গ্রামীণ হাসপাতালটি প্রসূতি মায়ের একজন 'বার্থ কম্প্যানিয়ন'-এর সঙ্গে একটি সস্তা অ্যালুমিনিয়াম পার্টিশন করেছে। এটা হয়ত আদর্শ নয়। কিন্তু গত ৩ বছরে ফলাফলে দেখা গিয়েছে প্রসবের সময় কেউ কোনও মায়ের কান্নাকাটি বা চিৎকার শুনতে পায়নি। একমাত্র নবজাতকের কান্নাই শোনা যাচ্ছে। নার্সিং কর্মীরাও জানিয়েছেন, এত শান্তিপূর্ণ স্বাভাবিক প্রসবের অভিজ্ঞতা আগে ছিল না।
স্বাস্থ্য দপ্তরের ওই সূত্রটি জানায়, সমস্ত কিছুই মস্তিষ্ককে বিশ্রাম করতে উৎসাহিত করে এবং দ্রুত ব্যথাহীন প্রসবের জন্য মায়ের মস্তিষ্ক থেকে অক্সিটোসিন নিঃসরণ করে। যা মায়ের মস্তিষ্ককে সন্তানের জন্মের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
এই ধরনের লেবার রুম কি ভবিষ্যতে জেলার বাকি হাসপাতালগুলিতে তৈরি করা হবে? দক্ষিণ ২৪ পরগণার সিএমওএইচ জানিয়েছেন, 'বিষয়টি নিয়ে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে।'