সাধারণ নাগরিকের কথা মাথায় রেখে কেন্দ্র সরকার সিদ্ধান্ত নেয় দেশজুড়ে ওষুধের গুণগতমান পরখ করে দেখা হবে। কথা মতো কেন্দ্র পরিচালিত সেন্ট্রাল ড্রাগ ল্যাবরোটরিতে (CDSCO) স্যালাইন-সহ সমস্ত ওষুধের গুণগতমান পরীক্ষা করা হয়। একই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও সেই পথেই হাঁটে। স্টেট ড্রাগ ল্যাবরোটরিতে ওষুধের গুণগতমান পরীক্ষা করা হয়। আর সেখানেই চরম বিপত্তি। পশ্চিমবঙ্গ-সহ প্রায় ১৫টি রাজ্যে ওষুধের গুণগতমান পরীক্ষায় বহু ওষুধ অনুর্তীর্ণ হয়। বহু ওষুধ পরীক্ষায় ফেল করার কারণে, প্রশ্ন ওঠে উপভোক্তাদের চিকিৎসা আগামীতে কতটা স্বাস্থ্যকর হবে। কারণ রোগীদের চিকিৎসার পর যদি ওষুধ ঠিক মতো দেওয়া না হয় অথবা জাল ওষুধ ব্যবহৃত হয় সে ক্ষেত্রে রোগীদের জীবন নিয়ে টানাটানি হতে পারে, এমনকি প্রাণ সংশয় পর্যন্ত হতে পারে। আর তারপরেই নড়ে চড়ে বসে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার।
খেলা শুরু আনুমানিক আট মাস আগে থেকে যখন 'হাফ সেঞ্চুরি' সংখ্যাক ওষুধ নট অফ স্ট্যান্ডার্ড কোয়ালিটি (NSQ)-র তালিকাভুক্ত হল। ডিসেম্বর থেকে এই সংখ্যা ১০০ পার করল এবং গত মাসে প্রায় ২০০ ওষুধ এই তালিকায় চলে এসেছে। এর মধ্যে জাল ওষুধ যেমন আছে, তেমনি অযোগ্য বা সাবস্ট্যান্ডার্ড ওষুধও আছে যা কাঁচামাল বা অন্যান্য উপাদানের গুণগত মানের জন্য হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।
কোন কোন রাজ্যে কতগুলো করে ওষুধ পরীক্ষায় ফেল করেছে? গুয়াহাটি ১২টি, মহারাষ্ট্র (মুম্বই) ২৩টি, চণ্ডীগড় ১১টি, কর্ণাটক ১২টি, তেলঙ্গানা ১২টি, চেন্নাই ১৭টি, মাদুরাই ২১টি, কেরল (তিরুবনন্তপুরম) ১৮টি, পাঞ্জাব ২১টি, পন্ডিচেরি ৮টি এবং পশ্চিমবঙ্গের ১৯৮টি ওষুধ পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়। এছাড়াও দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, ত্রিপুরা, গুজরাট, বিহার, ঝাড়খন্ড, হিমাচল প্রদেশ-সহ একাধিক রাজ্যে ফেল করা ওষুধের সংখ্যাটা নেহাতই কম নয়।
বলাবাহুল্য, এই সমস্ত ওষুধ উৎপাদন এবং পরীক্ষায় ফেল করা যা সম্পূর্ণ দায় কেন্দ্র সরকারের। কারণ, CDSCO-র সম্পূর্ণটাই নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্র। রাজ্যের দায়িত্ব থাকলেও প্রধান দায়িত্ব কেন্দ্র সরকারের। এখানেই প্রশ্ন, তাহলে ওষুধ প্রস্তুত হওয়ার পর কেন তার প্রকৃত পরীক্ষা না করে উপভোক্তাদের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে? যা কেন্দ্রের গাফিলতি বা উদাসীনতা বলা যেতে পারে।
কেন্দ্রীয় সরকার তাদের 'সুগম' পোর্টালে ওষুধের গুণমান বিচার করে। কোন ওষুধ আনুসঙ্গিক যোগ্যতামান উত্তীর্ণ করেছে এবং কারা তা পারেনি তার বিস্তারিত বিবরণ 'ই-গভর্নেন্স' এর দ্বারা CDSCO-এর ওয়েবসাইটে প্রতি মাসে তুলে ধরছে। রাজ্যেও অনুরূপ SDSCO রয়েছে তাতেও তুলে ধরা হচ্ছে রাজ্যস্তরে ওষুধের গুণমান সম্পর্কিত তথ্য। 'ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী স্থির হচ্ছে যোগ্যতামান। তাই অযোগ্য ও জাল ওষুধ আলাদা করা এখন আপাতদৃষ্টিতে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার এবং উপকৃত হচ্ছেন উপভোক্তারা। আর অন্যদিকে, প্রস্তুতকারী সংস্থা, ওষুধের মার্কেটিং সংস্থা, ক্যারিং এন্ড ফরোয়ার্ডিং, স্টকিস্ট, হোলসেলার, রিটেলার-দের মধ্যে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা।
উল্লেখযোগ্য বিষয়, এরই মধ্যে চিকিৎসকদের একাংশ এক প্রকার বিভ্রান্ত এবং ক্রমাগত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, প্রতিটি রাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্ব চিকিৎসকদের ওষুধ সম্পর্কে অবগত করা যে কোন ওষুধ পরীক্ষায় ফেল করছে বা করছে না। মূলত, ওষুধের গুণগত মান সম্পর্কে, না হলে তাঁদের চিকিৎসা করতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে আজকাল ডট ইন-এর পক্ষ থেকে কথা হয়েছিল ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের চিকিৎসক রঞ্জন ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তিনি বলেন, "CDSCO হল ভারতবর্ষের ওষুধ, প্রসাধনী ও চিকিৎসা সরঞ্জামের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। মার্কিনমুলুকের FDA, ব্রিটিশ বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মেডিকেল এজেন্সির মতোই কাজ করে, যার ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী শ্রী জগৎ প্রকাশ নাড্ডা। ড্রাগ কন্ট্রেল জেনারেলকে (DCGI) পরামর্শ দেয় ড্রাগ টেকনিক্যাল অ্যাডভাইসারি বোর্ড (DTAB) ও ড্রাগ কনসালটেটিভ কমিটি (DCC)। তাহলে 'হযবরল' করলে দাঁড়ায় সবটাই কেন্দ্রীয় ক্ষমতার কুক্ষিগত। কোথায় গেল সেই তিনদশকের 'বিকেন্দ্রীকরণ' পলিসি?"
তিনি আরও বলেন, "ভারতের 'ফার্মা ইন্ডাস্ট্রি' সারা পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম ব্যবহৃত ওষুধের নিয়ন্ত্রক। তাই আমাদের দায়িত্বও বাড়ছে, ১৪০ কোটি দেশবাসীর প্রতি দায়বদ্ধতাও বাড়ছে। রাজনীতির ঊর্ধ্বে, কেন্দ্রীয় সরকারকেও দায়িত্ব নিতে হবে কেন উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, হিমাচল প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খন্ড, মহারাষ্ট্র থেকে এই 'জাল, ভেজাল ও নকল ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার তালিকা দীর্ঘায়িত হচ্ছে।“