দিগন্ত মান্না, পাঁশকুড়া
মহাকবি বলেছিলেন, নামে কী যায়-আসে! কিন্তু পূর্ব মেদিনীপুর জানে, নামেও অনেক কিছু যায়-আসে।
এ রাজ্যেই রয়েছে পূর্ব-ভারতের সবচেয়ে বড় নামের রেলওয়ে স্টেশন। আকারে নয়, নামে। এই স্টেশনের নামকরণ নিয়ে দু’টি গ্রামের লোকজন রীতিমতো সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলেন। শুরু হয়েছিল আন্দোলন।
দুই গ্রামের মর্যাদার লড়াইয়ের ফলশ্রুতি হিসেবে স্টেশনটির নাম রাখা হয় নারায়ণ পাকুড়িয়া মুড়াইল। এমন নামের নেপথ্যে রয়েছে এক ইতিহাস। যা জানতে গেলে চল্লিশ বছর পিছনে এগিয়ে যেতে হবে।
১৯০০ সালে বেঙ্গল-নাগপুর রেইলাইন চালু হয়। সে সময়ে ডাউন লাইনে পাঁশকুড়ার পরের স্টেশন ছিল কোলাঘাট। পরে তৈরি হয় ভোগপুর, মেচেদার মতো স্টেশন। পাঁশকুড়া এবং ভোগপুর স্টেশনের মাঝে রয়েছে বিশাল এলাকা।
দু’টি স্টেশনের মাঝে দূরত্বও অনেক। পাশাপাশি গ্রামের মানুষজনকে কাছের রেলস্টেশনে যেতে অনেক সময় ব্যয় করতে হতো। পাঁশকুড়া ব্লকের প্রতাপপুর ১ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার মুড়াইল এবং কোলাঘাট ব্লকের ভোগপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার নারায়ণপাকুড়িয়া গ্রাম দু'টির অবস্থান পাশাপাশি। ওই দুই গ্রামের মানুষজন বাড়ির কাছে একটি রেল স্টেশনের স্বপ্ন দেখতেন।
পাঁশকুড়ার ধুলিয়াপুর গ্রামের বাসিন্দা, পেশায় শিক্ষক রাখালচন্দ্র ডগরা মুড়াইলে একটি স্টেশন তৈরির ব্যাপারে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। পরে এলাকার আরও বহু মানুষ সে ব্যাপারে রেলমন্ত্রকের কাছে দরবার শুরু করেন।
১৯৮১ সালের ২০ ডিসেম্বর রেলমন্ত্রক পাঁশকুড়া এবং ভোগপুর স্টেশনের মাঝে মুড়াইল নামে একটি নতুন স্টেশনের নাম ঘোষণা করেন। শুরু হয় স্টেশন তৈরির তোড়জোড়। সমীক্ষা শেষে মুড়াইল স্টেশনের স্থান নির্বাচন করা হয়।
দেখা যায়, স্টেশনটি যে জায়গায় হবে সেটির বেশিরভাগ এলাকা নারায়ণপাকুড়িয়া গ্রামের, আর কিছুটা এলাকা পড়ে মুড়াইলের। তা হলে স্টেশনের নাম শুধু মুড়াইল কেন? আপত্তি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করেন নারায়ণপাকুড়িয়া গ্রামের মানুষ।
তাঁদের দাবি নারায়ণপাকুড়িয়া গ্রামের জায়গায় তৈরি স্টেশনের নাম রাখতে হবে গ্রামের নামেই। ও দিকে, মুড়াইলের বাসিন্দারা দাবি করেন, তাঁদের গ্রামের নামে স্টেশনের নাম ঘোষণা হয়েছে। অতএব স্টেশনের নাম রাখতে হবে মুড়াইল।
রেল স্টেশন তৈরি হওয়া অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু সেই মুহূর্তে তার চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়ায় স্টেশনের নাম। শুরু হয় মর্যাদার লড়াই, আন্দোলন। স্টেশনের নাম নিয়ে দুই গ্রামের মানুষজন সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়েন। দু’টি গ্রামই নিজেদের দাবিতে অনড় থাকেন।
আন্দোলনের জল গড়ায় আদালত পর্যন্ত। আন্দোলন চললে স্টেশন তৈরি হবে কী করে? সমস্যার সমধানে আসরে নামতে হয় রেলের আধিকারিকদের। দুই গ্রামের লোকজনদের নিয়ে বৈঠক করেন রেলের কর্তারা।
রেলের তরফে প্রস্তাব দেওয়া হয়, নতুন স্টেশনের নাম দু'টি গ্রামের নামেই রাখা হবে। প্রস্তাবে বিবাদমান দু’পক্ষ রাজি হলেও কোন গ্রামের নাম প্রথমে রাখা হবে তা নিয়েও শুরু হয় নতুন বিতর্ক।
মুড়াইল গ্রামের বাসিন্দারা দাবি করেন, যেহেতু তাঁদের গ্রামের নামে রেল নতুন স্টেশনের নাম ঘোষণা করেছে তাই তাঁদের গ্রামের নাম প্রথমে রাখা হোক। ও দিকে, নারায়ণপাকুড়িয়া গ্রামের দাবি, যেহেতু স্টেশন তাঁদের গ্রামে তৈরি হবে তাই তাঁদের গ্রামের নাম প্রথমে রাখতে হবে।
নাম নিয়ে দীর্ঘ আন্দোলনের জেরে থমকে যায় স্টেশন তৈরির উদ্যোগ। মর্যাদার লড়াই করতে গিয়ে রেল যদি নতুন স্টেশনের ঘোষণা বাতিল করে দেয়! দেরিতে হলেও সার কথা বুঝতে পারে দুই গ্রাম।
শেষ পর্যন্ত হয় সমঝোতা বৈঠক। রেলের মধ্যস্থতায় সিদ্ধান্ত হয়, নতুন স্টেশনের নাম হবে নারায়ণ-পাকুড়িয়া মুড়াইল। ১৯৮৩ সালের ১৯ এপ্রিল চালু হয় নারায়ণ-পাকুড়িয়া মুড়াইল স্টেশন। এই স্টেশনের নামে বাংলা অক্ষর রয়েছে ১২টি। ইংরেজি অক্ষর রয়েছে ২০টি। নামের বিবাদ এখন অতীত।
আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক সুধাংশুশেখর ভট্টাচার্য বলেন, ‘এই স্টেশনের নামের সঙ্গেও বহু আন্দোলন জড়িয়ে রয়েছে। রেলস্টেশনের এমন নাম খুব কমই চোখে পড়ে।’ সাউথ-ইস্টার্ন রেলওয়ে (হাওড়া-জকপুর) প্যাসেঞ্জার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সহ সভাপতি সমীর সামন্তের কথায়, ‘নারায়ণ-পাকুড়িয়া মুড়াইল স্টেশন বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন।’