• স্বপ্ন বুনতে শেখাচ্ছেন বীণা, সীমা
    এই সময় | ০৮ জুন ২০২৫
  • শীর্ষেন্দু দেবনাথ

    ‘করব, লড়ব, জিতব রে...’। একদা মাওবাদী প্রভাবিত গড়বেতা ৩ ব্লকের প্রত্যন্ত এলাকার মহিলারা কলকাতা নাইট রাইডার্সের স্লোগানটা আদৌ শুনেছেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু বাস্তবে সীমা দাস ও বীণা ভুইঞা কিন্তু করে, লড়ে, জিতেই চলেছেন।

    তাঁদের এই সাফল্যের রথে সওয়ার হয়েছেন আরও অনেকে। সামান্য পুঁজি নিয়ে স্বনির্ভরতার স্বপ্ন দেখা শুরু করা ওই দুই মহিলা নিজেরাই শুধু সফল নন, আরও অনেককে স্বাবলম্বী করে তুলেছেন।

    সম্প্রতি সরকারি ভাবে ওডিশায় আয়োজিত ‘লাখোপতি দিদি’ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে তাঁদের সাফল্যের কাহিনিও তুলে ধরেন তাঁরা। সে গল্প এখন উদ্বুদ্ধ করে চলেছে অন্য মহিলাদেরও। তাঁদের ‘রোল মডেল’ হিসেবে দেখাতে চাইছেন ব্লক প্রশাসনের কর্তারাও।

    সালটা ২০১১, গড়বেতা ৩ ব্লকের ছোট ডাবচা গ্রামের আটপৌরে সীমার শাশুড়ি তখন অসুস্থ। শাশুড়ির জায়গায় স্বনির্ভর গোষ্ঠীর দলে নাম লেখান সীমা। ট্রেনিং নেন। ওই গোষ্ঠীর বিভিন্ন কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে থাকেন তিনি। ২০১৪-এ নিজের ৭০০ টাকা নিয়ে তিনি শুরু করলেন শাঁখার ব্যবসা। সেখানে ৫০০ টাকা লাভ হয়েছিল।

    অনেকটা পথ হেঁটে সেই ব্যবসা দাঁড় করান তিনি। শাখার সঙ্গে জুড়ে যায় সিঁদুর, আলতার ব্যবসাও। সরকারি সহযোগিতায় বাড়ির সঙ্গে নিজের একটা দোকানও তৈরি করে ফেলেন। লাভের অঙ্ক বাড়তে থাকে।

    নিজের স্বামীকে ভূসিমালের দোকানও করে দেন। ২০২৪-এ সেখানেই থেমে না থেকে তিনি ছাগলের ব্যবসায় (মূলত মাংস) নামেন। ওই এলাকায় এর আগে যদিও কোনও মহিলা এরকম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাঁর স্বামীও খানিক চটে যান। কিন্তু সীমা থামেননি।

    কারণ, ততদিনে পোক্ত ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছিলেন সীমা। অন্য দোকানের থেকে কম দামে, ভালো মানের মাংস বেচে সুনাম তৈরি করে ফেলেন তিনি। এমনকী ‘হোম ডেলিভারি’ সার্ভিসও চালু করে ফেলেন। চড়চড় করে উন্নতি হতে থাকে। তাঁর ব্যবসায় হাত মিলিয়েছেন ৩০ জন মহিলাও। তাঁরা বলছেন, ‘দিদির জন্যই কাজটা হয়েছে...’।

    কোনও রাখঢাক না-রেখে তাঁর বক্তব্য, ‘আনন্দধারা প্রকল্পই আমার জীবনে আলো এনেছে। আমার মনে হয়, সরকারি প্রকল্পের সঠিক ব্যবহার করে গ্রামের সব মহিলাই লাখপতি বা ক্রোড়পতিও হতে পারেন। জেলা এবং ব্লক প্রশাসনের কর্তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। তাঁরা সব সময় আমাদের পাশে থেকেছেন।’

    অন্য দিকে রয়েছেন বীণা ভুঁইঞা। বাড়ি বড় ডাবচায়। ২০০৯-এ স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। বীণার কথায়, ‘তখন সদ্য বিয়ে করেছি, পাড়ার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা আসতেন। একজনের থেকে জানলাম দলে যোগ দিতে ৬০ টাকা লাগে। সে টাকা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না আমার। পরে কিছু মহিলাই এগিয়ে এসে আমার টাকা দেন। কাজ শুরু করি।’

    ২০১১ সালে লোনের ভাগ হিসেবে ৪০০০ টাকা পেয়ে তিনি চাষ শুরু করেন। পুনকা, কলমি ফুলের চাষ করে ৪০ হাজার টাকা লাভ করেন তিনি। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। তরতরিয়ে ব্যবসার উন্নতি হয়েছেন। সঙ্গে আচারের ব্যবসাও করতে থাকেন বীণা। বছরে তাঁরও লাভের পরিমাণ প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ।

    ব্লকের আনন্দধারা প্রকল্পের নোডাল অফিসার দেবারতি মেইকাপ গুহ বলছিলেন, ‘সীমাদির ব্যবসায়িক বুদ্ধি প্রখর। বীণাদির মূলধন শ্রম। দু’জনে কী ভাবে নিজেদের চেষ্টায় এবং সরকারি সহযোগিতায় এই জায়গায় এসেছেন। ওঁরাই এখন সবার রোল মডেল।’

    গড়বেতা ৩ ব্লকের বিডিও দীপাঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘এরকম আরও কেউ এগিয়ে আসতে চাইলে আমরা সব ভাবে পাশে থাকার চেষ্টা করব।’

  • Link to this news (এই সময়)