• উটের পেট ভরে কীসে! ধন্দে পুলিশ, রওনা মরু-রাজ্যে
    এই সময় | ০৮ জুন ২০২৫
  • পুলক বেরা, তমলুক

    যে কোনও মুহূর্তে যুদ্ধ শুরু হবে, এমন পরিস্থিতি। রাজস্থানের জয়সলমেরের লঙ্গেওয়ালায় পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর বিভিন্ন তল্লাটে ছানবিন করছে ভারতীয় সেনা এবং বিএসএফ। এমনই এক রাতে তল্লাশি অভিযানের সময়ে একদল উটের সবুজ ঘাস খাওয়া ধরিয়ে দিয়েছিল তীর্থযাত্রীদের ভেক ধরে থাকা পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীদের।

    কারণ, সবুজ ঘাস মেলে শুধু ওই বর্ডারের ও পারে। ‘বর্ডার’ ছবির দৃশ্য। ১৯৭১-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের লঙ্গেওয়ালা সংঘর্ষের ঘটনাবলির ভিত্তিতে যে ছবি তৈরি হয়েছিল।

    আর লঙ্গেওয়ালা থেকে প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে, বাংলার পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সুতাহাটা থানার পুলিশকে গত ক’দিন নাজেহাল হতে হলো উট কী খাবে, তা নিয়ে। একটা-দু’টো নয়, ১১টা উট।

    ‘সোনার কেল্লা’-তে লালমোহনবাবুর প্রশ্নের উত্তরে ফেলুদা জানিয়েছিলেন, উটের খাদ্য প্রধানত কাঁটাঝোপ এবং উট কাঁটা বেছে খায় না। তবে সুতাহাটায় আর কোথায় মিলবে কাঁটাঝোপ?

    দিন কয়েক আগে উটগুলো উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসা হয়। থানার বড়বাবু এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে ডেকে বলে দেন, ‘ওরে, উটগুলোর খাওয়ার ব্যবস্থা কর। আমাদের কাস্টডি-তে উটগুলোর কিছু একটা হয়ে গেলে আর দেখতে হবে না।’

    গত বুধবার সকাল থেকে রাত, জলপাইগুড়ির মালবাজার থানার পুলিশকে একটি চোরাই খাসি উদ্ধার করার পর যারপরনাই ব্যতিব্যস্ত হতে হয়েছিল। থানার ভিতরেই এক কোণে বেঁধে রাখা খাসিটিকে সময়ে সময়ে খাওয়ানো হয়েছিল ঘাস-পাতা-ডালপালা।

    তার উপর যে ছাগল চুরির তদন্তে নেমে ওই খাসির সন্ধান মেলে, সেই ছাগলের এখনও কোনও হদিশ নেই। মালবাজার থানায় ছাগল-খাসির সেই পালা সাঙ্গ হওয়ার আগেই সুতাহাটা থানায় উট নিয়ে উটকো ঝামেলা।

    বড়বাবুর আদেশ পেয়ে সুতাহাটা থানার সিভিক ভলান্টিয়ার প্রথমে পড়লেন আতান্তরে। শেষমেশ সহায় হলো ডিজিটাল সিধু জ্যাঠা অর্থাৎ গুগল। কাঁটাঝোপ ছাড়াও উট শুকনো ঘাস এবং লতাপাতা খায়। ব্যস! এ বঙ্গে তো আর তৃণের অভাব নেই। গত পাঁচ দিন ধরে সেই সিভিক তরতাজা ঘাস, গাছের পাতা খাইয়েছেন অতিথি উটদের।

    চোরাপথে রাজস্থান থেকে সেই অতিথিরা এসে পৌঁছেছিল সুতাহাটার দুর্বাবেড়িয়ায়। সেই উট ‘বিক্রয় করা হইবে’ বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টিয়ে দেন কেউ। সেটা দেখেই পশু সুরক্ষা সংগঠনের তরফে অভিযোগ দায়ের করা হয় সুতাহাটা থানায়।

    ‘প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যাল্‌স অ্যাক্ট’–এ মামলা রুজু করে পুলিশ তড়িঘড়ি ১১টি উট উদ্ধার করে। কিন্তু একে তো উটদের খাওয়ার ব্যবস্থা। তার উপর অতগুলো উট দেখতে থানার সামনে ছোট-বড়দের ভিড় সামাল দেওয়া।

    বিরক্ত এক পুলিশকর্মী তো বলেই ফেললেন, ‘এই ক’দিনে বুঝতে পারছিলাম না, থানা নাকি চিড়িয়াখানা, ঠিক কোথায় ডিউটি করছি!’

    আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না-পেরে দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছিল উটগুলোও। প্রাণিসম্পদ বিকাশ দপ্তরের তরফে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশে এবং সুতাহাটা থানা ও প্রাণিসম্পদ বিকাশ দপ্তরের ব্যবস্থাপনায় উটের দলকে শুক্রবার রাতে রওনা করানো হয়েছে রাজস্থানের উদ্দেশে।

    পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হলদিয়া) মনোরঞ্জন ঘোষ বলেন, ‘উটগুলোকে উদ্ধার করা ইস্তকই তাদের খাওয়াদাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আদালতের নির্দেশে তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানো হয়েছে।’

    প্রাণী সুরক্ষা সংগঠনের সদস্য সুব্রত দাস বলেন, ‘উটগুলোকে বিক্রি করা কিংবা বাংলাদেশে পাচার করার মতলব ছিল। পুলিশের ভূমিকায় আমরা খুশি। অভিযুক্তরা ধরা পড়লে আরও খুশি হব।’

    বছর কয়েক আগে উট নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছিল বারাসত থানার পুলিশ। কালীপুজোয় স্থানীয় একটি পুজো কমিটি থিম করেছিল রাজস্থানের মরুভূমি। তারা উট এনেছিল রাজস্থান থেকে। তবে পুজোর পর সেই উট ফেরত পাঠানো হয়নি।

    বারাসত শহরের বিভিন্ন জায়গায় উট ঘুরে বেড়াত, মুখ বাড়িয়ে এ দোকান, সে দোকান থেকে খাবার খেত। একদিন এক দোকানি তার মুখে গরম জল ছুড়ে মারায় বীভৎস আহত হয় উটটি।

    এ নিয়ে পশুপ্রেমীদের একটি সংগঠন মামলা করলে পুলিশ সেই উটকে নিয়ে আসে বারাসত থানায়। দিনের পর দিন বারাসত থানাই হয়ে ওঠে উটের আবাস। শেষমেশ দক্ষিণ শহরতলির কালিকাপুরের একটি পশু হাসপাতালে উটটিকে দিয়ে এসে পুলিশের স্বস্তি মিলেছিল।

    সুতাহাটা থেকে শুক্রবার রাতে উটেরা রওনা হওয়ার পর কপালের বিনবিনে ঘাম রুমালে মুছে সেই সিভিক ভলান্টিয়ার বলছেন, ‘যাক বাবা, বাঁচলাম!’ কেবল তিনি একা নন, হাঁপ ছেড়ে বেচেছেন সুতাহাটা থানার সবাই। তার মানে, শুধু দুষ্টু লোক-ই উট দেখলে ভয় পায় না!

  • Link to this news (এই সময়)