• টোটোর দাপটে অবসরের পথে রিকশা, ব্রাত্য তিনচাকার যান, শুধুই নস্টালজিয়া
    এই সময় | ০৮ জুন ২০২৫
  • সুদীপ দত্ত

    উত্তরবঙ্গে টোটোর দাপট শুরু হওয়ার আগে যে বাহনটি মানুষকে শহরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দিত, তার নাম রিকশা। তিন চাকার যানটিতে বসা যেত দু’জনে। গদি দেওয়া আসন। রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ছিল ‘হুড’।

    কোনও রিকশায় আবার বর্ষাকালে তার সঙ্গে শোভা পেত দড়ি বাঁধা প্লাস্টিকের পর্দা, যাত্রী যাতে ভিজে না-যায় তাই এমন ‘সজ্জা’। রিকশার সামনে হ্যান্ডেলে লাগানো থাকত হর্ন। একটু ‘অবস্থাপন্ন’ রিকশা-চালকরা আবার হ্যান্ডেলে আলোও লাগাতেন।

    এই চালকদের দাপটও কিছু কম ছিল না। দিনে সহজে যাত্রী নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতে রাজি হলেও রাতে অনেকেই ‘মেরি মর্জিতে’ চলতেন। অর্থাৎ, গন্তব্য পছন্দসই হলে তবেই যাবেন। তবে বিপদের দিনের মূল ভরসা ছিল এই রিকশা। অন্তত নিম্ন আর মধ্যবিত্তদের।

    মুমূর্ষু রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া বা যখন চিকিৎসকরা বাড়িতে গিয়ে রোগী দেখতেন তখন, রিকশাই আমজনতাকে উদ্ধার করেছে। পাশাপাশি, কলেজ জীবনের কত ‘জুটি’কে নিয়ে যে রিকশা পাড়ি দিয়েছে তার হিসাব কেউ রাখেনি। কালের নিয়মে সেই ছবি ঝাপসা হয়ে গেলেও আজও কোনও প্রবীণ সেই স্মৃতি রোমন্থন করেন।

    শিলিগুড়ির প্রবীণ নাগরিক অশোক বিশ্বাস যেমন বলছেন, ‘আশির দশকে কলেজে পড়তাম। রাগ-অনুরাগ পর্বের সূত্রপাত তখনই হয়েছিল। অনেক সাহস সঞ্চয় করে একদিন দু’জনে রিকশায় চেপে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। আবার, বিয়ের পরেও দু’জনে মিলে রিকশায় চেপে পুজোর সময়ে ঠাকুর দেখেছি।’

    রিকশার অন্য ভূমিকাও ছিল। মাল্টিপ্লেক্স যুগের আগে উত্তরের সব শহরেই কমবেশি কিছু সিনেমা হল ছিল। সেখানে নতুন কোনও সিনেমার ‘শো’ শুরু হতো শুক্রবার। সকালে সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ রিকশা ভাড়া করতেন। তার হ্যান্ডেলে বাঁধা হতো মাইক।

    আর পিছনে লাগানো হতো সিনেমার পোস্টার। তার পরে রিকশায় চেপে সিনেমা হলের কর্মী শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে সিনেমার নাম, তার কুশীলব আর ‘শো টাইম’ ঘোষণা করতেন। আজকের ‘টিজার’-এর বদলে তখন এ ভাবেই মানুষ জানতে পারতেন ‘অমানুষ’, ‘শোলে’ বা ‘অনুসন্ধান’- সিনেমার কথা।

    শহরের বাসিন্দা পায়েল সরকার বলেন, ‘এখনও মনে আছে রিকশায় চেপেই ‘অমানুষ’ দেখতে গিয়েছিলাম। ফিরেওছিলাম সেই রিকশায়।’ এক সময়ে নাগরিক জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা তিন চাকার এই যান এখন প্রায় হারিয়ে যাওয়ার পথে। টোটোর জমানায় এখনও যাঁরা রিকশা চালান তাঁদের মূল ভরসা রবিবার সকালে সব্জি আর মাছবাজার ফেরত মানুষেরা।

    হতদরিদ্র এই চালকরা অক্লেশে সারা সপ্তাহের ব্যাগ ভর্তি বাজার রিকশায় উঠিয়ে যাত্রীকে নিয়ে রওনা দেন। গন্তব্যে পৌঁছে তাঁরাই ব্যাগ নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেন। যাত্রীর গন্তব্য শেষ হয় ঠিকই, তবে হাতে গোনা যে ক’জন রিকশা চালক এখনও আছেন, তাঁদের টিকে থাকার লড়াই এখন গন্তব্যহীন!

  • Link to this news (এই সময়)