প্রশান্ত পাল, পুরুলিয়া
এখানে ইতিহাস ও সময় থমকে গিয়েছে।
খাঁ খাঁ রাজপ্রাসাদের অলিন্দ থেকে অজানা পাখির ডাক কানে এলে চোখের সামনে কেমন যেন ভেসে ওঠে সিলুট রংয়ের কত ছবি! অহল্যাভূমি বা অটবী দেশ পুরুলিয়ার একটি ব্লক কাশীপুর, যে জনপদের প্রসঙ্গ উঠলেই চলে আসে পঞ্চকোটের নাম।
তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ডাকের চিঠি প্রাসঙ্গিকতা একেবারে হারিয়ে ফেললেও সাকিন কাশীপুরের ডাকঘর হিসেবে আজও যেন এক ট্র্যাডিশন বহন করে চলেছে।
সাল ১৮৩২। পুরুলিয়ার কেশরগড় ছেড়ে পঞ্চকোট রাজবংশ তাদের রাজধানী গড়ে তুলেছিল কাশীপুরে। সে সময়ে পঞ্চকোটের রাজা ছিলেন মহারাজ নীলমণি সিংহদেও। তার পরে এলো ১৮৫৭। সিপাই বিদ্রোহের গুরুগুরু গর্জন।
ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের আঁচ তো প্রবল আকার নিয়েছিল মানভূমেও। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পুলিশ বিদ্রোহে যুক্ত থাকার অভিযোগ তুলে নীলমণিকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়েছিল কলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে।
সেই বংশের ৮০তম রাজা ছিলেন জ্যোতিপ্রসাদ সিংহদেও। কাশীপুরের রামবনি মৌজায় ১৯১৬ সালে তৈরি করেছিলেন সুদৃশ্য জ্যোতিবিলাস নামে রাজপ্রাসাদ। গবেষকরা বলেন, ২১ বিঘা জমির উপরে টানা ১২ বছর ধরে তৈরি হয়েছিল এই প্রাসাদ।
চিন থেকে মিস্ত্রি আনা হয়েছিল প্রাসাদ গড়ে তুলতে। ৪০ ফুট উঁচু প্রাচীরে ঘেরা এই প্রাসাদের দোতলায় রয়েছে তিনটি হল। তা পরিচিত ব্রিটিশ হল, দরবার হল ও পূজা হল নামে। এ ছাড়াও রাজা, রানি, রাজকুমারীর কক্ষ, পূজার ঘর, সিপাইদের কক্ষ, অফিসঘর সমেত রয়েছে আরও নানা ঘর।
বিশিষ্ট অতিথি এবং বিদেশ থেকে আসা ব্রিটিশ প্রতিনিধিদের আপ্যায়ন করা হতো ব্রিটিশ হলে। জেলার বিশিষ্ট ইতিহাস গবেষক দিলীপ কুমার গোস্বামী বলছিলেন, ‘দেশের বিশিষ্ট শিল্পীরা এসে ছবি এঁকে গিয়েছেন।
ছিল নানা ধরনের অয়েল পেন্টিং। ছিল জার্মান পিয়ানো, বেলজিয়াম কাচের আয়না, মেঝেতে ছিল ইটালিয়ান মার্বেল।’ সেখানেই শেষ নয়। এই রাজপ্রাসাদের পরতে পরতে রয়েছে ইতিহাসের কত না অলিগলি!
অমিত্রাক্ষরের স্রষ্টা মধুসূদন দত্ত কিছুদিনের জন্য থেকেছিলেন এই প্রাসাদে। সঙ্গীতজ্ঞ যদুভট্ট, নৃত্যশিল্পী অলকনন্দা, গহরজান, নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ি, ঝুমুর কবি ভবপ্রীতানন্দ ওঝা, নাচনি সিন্ধুবালা দেবী-সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের পদার্পণ ঘটেছে এই রাজপ্রাসাদে।
মহারাজা জ্যোতিপ্রসাদ কাশীপুরে নতুন প্রতিভার অন্বেষণে সারস্বত সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে সঙ্গীত, অভিনয় ও শিল্পচর্চার একটি পরিমণ্ডল গড়ে তুলেছিলেন। পরবর্তী সময়ে অনেক খ্যাতিমান চিত্র পরিচালকের ক্যামেরা ধরেছে এই রাজপ্রাসাদের ঐতিহ্য।
এই বংশের হাত ধরেই শিখরভূমে দুর্গাপুজোর প্রচলন ঘটে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় গবেষকেরা। এই বংশের উত্তরপুরুষ সোমেশ্বরলাল সিংহদেও বলছিসেন, ‘আমরা যে হেতু সূর্যবংশের উত্তরসূরি, তাই এই বংশের পুজো আজও শুরু হয় রামচন্দ্র যে দিন রাবণবধের জন্য অকালবোধন করেছিলেন, সেই তিথি মেনে। এখনও ধুমধাম করেই পুজো হয়।’
পুজো রয়েছে, দাঁড়িয়ে রয়েচে রাজপ্রাসাদও। কিন্তু হারিয়ে গিয়েছে সোনালি ইতিহাস। কলকাতার দুর্গাপুজোকে ‘হেরিটেজ’ স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। পুরুলিয়ার মানুষ চান, এই রাজবাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অনেক অজানা ইতিহাস এ বার আসলুক প্রকাশ্যে। রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে নতুন এক পরিচিতি নিয়ে ফিরে আসুক পঞ্চকোটের রাজবাড়ি।