দুর্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বাঁকুড়া
ডায়না, ভোলু, বেবি, লালু। আদরের সেই সারমেয়রা আজ আর নেই। তবে বাড়ি থেকে হারিয়ে যায়নি তাদের স্মৃতি।
বলা ভালো, তা হারিয়ে যেতে দেননি বাঁকুড়া শহরের সুকান্তপল্লির বাসিন্দা গৌতম মণ্ডল ও তাঁর স্ত্রী শ্রাবণী মণ্ডল। সন্তান-স্নেহে বড় করে তোলা ওই চার পোষ্যের মৃত্যুর পরে বাড়ির ছাদেই সমাধিস্থ করেছেন। ফলকে বড় হরফে লেখা নাম। রোজ সকালে দেওয়া হয় ফুল। সন্ধেয় জ্বলে ধূপ, মোমবাতি।
এখানেই শেষ নয়। ডায়না, ভোলুরা না-থাকলেও এই দ্বিতল বাড়ির দরজা পথ-কুকুরদের জন্য খোলা। নিয়মিত কমপক্ষে খান কুড়ি কুকুরের যাতায়াত তো রয়েইছে। রয়েছে পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা, অসুস্থ হলে উপযুক্ত চিকিৎসা।
গৌতম পেশায় এলআইসি-র অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার। আদি বাড়ি ছিল দোলতলায়। সেখান থেকে খানিক দূরে সুকান্তপল্লি মাঠপাড়ায় নতুন বাড়ি করে বসবাস শুরু বছর কুড়ি আগে। স্ত্রী ও এক ছেলে অভিজ্ঞানকে নিয়ে সংসার।
নতুন বাড়িতে আসার পরে স্ত্রীর আবদারেই ২০০৫ সালে জার্মান স্পিটজ় জাতের একটি কুকুর (ফিমেল) কেনেন তিনি। নাম দেন ডায়না। ২০১১ সালে ডায়না জন্ম দিয়েছিল ছয় সন্তানের। জন্মের পরে একটি মারা যায়।
বাকি পাঁচটির মধ্যে একটি নিজের কাছে রেখে বাকি চারটি বন্ধু ও আত্মীয়দের দেন গৌতম। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই আবার ফেরত আসে দু’টি ছানা। ডায়না ও তার তিন সন্তান ভোলু, বেবি ও লালু বড় হয় মণ্ডল দম্পতির স্নেহে।
২০১৩ সালে মাত্র ৮ বছর বয়সে মৃত্যু ডায়নার। তখনই তাকে বাড়ির ছাদে সমাধি দিয়েছিলেন গৌতম। কিন্তু তিন বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় ভোলু, বেবি, লালুর জীবনও। ভোলু মারা যায় ২০১৫ সালে মাত্র ৪ বছর বয়সেই।
বেবির মৃত্যু ৫ বছর বয়সে ২০১৬ সালে। লালু মারা যায় ২০১৭ সালে ৬ বছর বয়সে। গৌতম বলছিলেন, ‘ওরা খুব আদরের ছিল। একে একে সকলে চলে যাওয়ায় খুব কষ্ট পেয়েছি। মন যখন খুবই ভারাক্রান্ত হয়, তখন সমাধিগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াই।’
কিন্তু মণ্ডল দম্পতির সারমেয়–প্রেমে তো ভাটা পড়েনি। পথ–কুকুরদের জন্য খুলে গিয়েছে দরজা। ভোর পাঁচটা বাজলেই যা উন্মুক্ত হয়ে যায়। পাড়া–সহ আশপাশের এলাকা থেকে চলে আসে ২০টির মতো সারমেয়।
তাদের জন্য আলাদা করে ভাত করে রেখে দেন শ্রাবণী। ভোরে উঠে তৈরি হয় তরকারি। মেনুতে কী থাকে? শ্রাবণী বলছেন, ‘ভাতের সঙ্গে তরকারি, মাছ। মাঝেমধ্যে রুটি-মাংস। কখনও দুধও দেওয়া হয়। আর বিস্কুট তো খায় হরদম।’
সন্ধেয় গৌতম ফেরার পরে অন্য উৎসব। শরীর এলিয়ে দিয়ে শুয়ে থাকে পথ-কুকুরের দল। রাতের খাওয়া সেরে রাত ১১টা নাগাদ ওরা বেরিয়ে যায়। গৌতম বলছেন, ‘ছোট থেকেই পশুপাখি ভালোবাসতাম। সময়ের সঙ্গে ভালোবাসা বেড়েছে। এই পথ–কুকুরদের সেবা করে তৃপ্তি পাই।’
বছর ৫৪-এর গৌতমের সারমেয় প্রেমের আরও গল্প রয়েছে। ৮–৯ মাস আগে একদিন বাড়ির অদূরে দেখেন মাস তিনেকের একটি কুকুর ছানা রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছে। সামনের দুটো পায়ের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে গাড়ির চাকা।
তাকে তুলে আনেন বাড়িতে। তার ঠিকানাও এখন মণ্ডল পরিবার। এখনও চার পায়ে দাঁড়াতে পারে না সে। সম্প্রতি অনলাইনে অর্ডার দিয়ে ওর জন্য একটি ডগ হুইলচেয়ার কিনেছেন গৌতম। হাজার সাতেক টাকা খরচ পড়েছে। তবে তাতে কী! ওই কুকুর ছানা ফের হাঁটতে পারছে যে।