মণিপুষ্পক সেনগুপ্ত
‘বাক্স বদল’ নয়, ‘লেটার হেড’ বদল!
এতদিন ‘লেটার হেড’-এ জ্বলজ্বল করত ভারতীয় জনতা পার্টি। হয়ে গেল ‘ভারতীয় জনতা লেজিসলেচার পার্টি’! কী ভাবে এমন হলো? কেনই বা হলো? তা নিয়েই এখন জোর চর্চা গেরুয়া ব্রিগেডে। কারণ, বঙ্গের গেরুয়া শিবিরের অনেকেরই মত, ‘বাক্স বদল’-এর মতো ‘লেটার হেড বদল’ রহস্য নিতান্তই অরাজনৈতিক নয়।
মাঝেমধ্যেই নানা বিষয়ে অভিযোগ জানাতে নির্বাচন কমিশনে হজির হয় রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। ২০২১–এর পরে বহুবার বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে বিজেপি নেতারা কমিশনে গিয়েছেন। জমা দিয়েছেন অভিযোগপত্রও। রীতি মেনে সেই স্মারকলিপির লেটার হেডে লেখা থাকে ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’।
হঠাৎই বদলে গিয়েছে সেই লেটার হেড! আগামী বিধানসভা ভোট অবাধ এবং স্বচ্ছ করার দাবিতে গত ২৬ মে শুভেন্দু অধিকারীরা একটি দাবিসনদ জমা দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অধিকারিককে।
প্রতিবারের মতো এ বারের চিঠির ‘হেড’–এ ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’ লেখা নেই। তার জায়গায় লেখা ‘ভারতীয় জনতা লেজিসলেচার পার্টি’! বিধানসভা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্থায়ী সরকারি কর্মচারীদের নিযুক্ত করার দাবিতে এর আগে গত ৭ মে কমিশনের কাছে লিখিত আর্জি জানিয়েছিলেন শুভেন্দুরা।
সেই আর্জিপত্রের ‘হেড’-এ অবশ্য ভারতীয় জনতা পার্টিই লেখা ছিল। বিজেপির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমীকরণের নিরিখে এই ‘লেটার হেড’ বদল যে যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
শুধু বিজেপি নয়, কংগ্রেস, তৃণমূলের মতো আরও অনেক রাজনৈতিক দলও নানা সময়ে লিখিত দাবিদাওয়া জানায় নির্বাচন কমিশন, বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে, রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতির কাছে।
কিন্তু একান্ত ভাবে সংসদীয় পরিসরের বাইরে কোথাও প্রথম সারির রাজনৈতিক দলগুলির তরফে স্মারকলিপি বা অভিযোগপত্র দেওয়া হলে সাধারণত তাদের সংসদীয় অথবা পরিষদীয় দলের লেটার হেড আলাদা করে ব্যবহারের চল নেই।
কোনও ক্ষেত্রে বিধানসভা বা লোকসভার দলনেতার প্যাডে লেখা চিঠিতে সই করেন বাকি বিধায়ক বা সাংসদরা। অথবা সরাসরি পার্টির লেটার হেডেই চিঠি লেখা হয়। তা হলে হঠাৎ এই ‘ব্যতিক্রম’ কেন বঙ্গ–বিজেপিতে?
বিজেপির পরিষদীয় দলের অবশ্য যুক্তি, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কারণ, গত ২৬ মে কমিশনে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে, সেখানে শুভেন্দু অধিকারী ছাড়াও দলের আরও অনেক বিধায়কের সই ছিল। তাই বিজেপির পরিষদীয় দলের লেটার হেড ব্যবহার করা হয়েছে।
কিন্তু বিজেপির অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছে, ২৬ তারিখের চিঠিতে বিজেপি বিধায়করা ছাড়াও দলের বর্ষীয়ান নেতা শিশির বাজোরিয়ার সই ছিল। তিনি তো বিধায়ক নন! তা হলে কেন লেটার হেডে শুধু ‘ভারতীয় জনতা লেজিসলেচার পার্টি’ থাকবে? দলের লেটার হেড ব্যবহার করতেই বা কোথায় বাধা ছিল?
কারণ, ওই বিধায়করা তো বিজেপির টিকিটে জিতেই বিধায়ক হয়েছেন। বঙ্গ–বিজেপির এক সাংগঠনিক নেতার কথায়, ‘অতীতে একাধিকবার শুভেন্দু অধিকারী, শিশির বাজোরিয়ার সঙ্গে বিজেপি বিধায়করা কমিশনে চিঠি দিয়ে এসেছেন।
কই, তখন তো বিজেপির পরিষদীয় দলের লেটার হেড ব্যবহার করা হয়নি! বিজেপির সাংগঠনিক দল আর বিজেপির পরিষদীয় দল যে আলাদা নয়, সেটা আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে।’
বাংলায় বিজেপির সাংগঠনিক দল আর পরিষদীয় দলের মধ্যে সুক্ষ্ম বিভাজন রেখা শুরু থেকেই ছিল। দলের মধ্যে বারবার অভিযোগ উঠেছে, বিজেপির সাংগঠনিক কর্মসূচিগুলিতে বিধায়কদের সে ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সে ক্ষেত্রে পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলা হয়েছে, বিধায়করাও পার্টির স্থানীয় পদাধিকারীদের অন্ধকারে রেখে নানা কর্মসূচি পরিকল্পনা করেন।
বিধানসভা ভোটের মুখে বিজেপির অন্দরের এই দড়ি টানাটানি আরও প্রকট হচ্ছে কি? আগামী বছর বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনের আগে যেখানে বারবার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব একজোট হয়ে কাজ করার কথা বলছেন, সেখানে এ ভাবে পরিষদীয়–সাংগঠনিক দলের টানাপড়েনে তো অনৈক্যের ছবিই নিচুতলায় ছড়িয়ে পড়বে! ‘লেটার হেড’ বিতর্ক থেকে তেমনই ইঙ্গিত পাচ্ছে রাজনৈতিক মহল।
বিজেপির পরিষদীয় দলের দাবি, ‘লেটার হেড বদল’ খুবই অকিঞ্চিৎকর একটি বিষয়। এটা নিয়ে অযথা জলঘোলা করার কোনও মানে হয় না। বিধানসভায় বিজেপির সচেতক শঙ্কর ঘোষের ব্যাখ্যা, ‘বিজেপি বিধায়করা সম্মিলিত ভাবে যখন বিধানসভার স্পিকারকে কোনও চিঠি দেন, তখন তো বিজেপির পরিষদীয় দলের লেটার হেডই ব্যবহার করা হয়। এটা খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, বিধানসভার বাইরে কেন সেই লেটার হেড ব্যবহার করা হলো? কিন্তু চিঠিটা তো বিজেপি বিধায়করাই দিয়েছেন। সেখানে শিশির বাজোরিয়ারও সই আছে ঠিকই। সেটা পার্টির সঙ্গে সমন্বয় রক্ষার জন্য।’
শিশিরের প্রতিক্রিয়া, ‘তৃণমূল কিছুতেই চাইবে না, আগামী বিধানসভা ভোট অবাধ এবং শান্তিপূর্ণ হোক। তাই আমাদের পার্টির বিধায়করা ঐক্যবদ্ধ ভাবে চিঠি লিখে নির্বাচন কমিশনের নজরে কিছু বিষয় এনেছিলেন।’
সেই চিঠিতে কি বিজেপির লেটারহেড ব্যবহার করা যেত না? কিছুক্ষণ থেমে শিশিরের জবাব, ‘তা যেত।’