• বাড়িতেই সেক্স র‍্যাকেট মা-ছেলের, জোর করায় আত্মঘাতী মেয়ে
    এই সময় | ০৯ জুন ২০২৫
  • সুপ্রকাশ চক্রবর্তী, হাওড়া

    ফ্ল্যাটে নাকি সেক্স র‍্যাকেট চালাতেন মা ও ছেলে, অভিযোগ করছেন তাঁদের প্রতিবেশীরা।

    অভিযুক্ত সেই মা শ্বেতা খান নিজের মেয়েকেও জোর করে দেহ ব্যবসায় নামাতে চেয়েছিলেন। প্রথম দিকে প্রতিবাদ করে লাভ না হওয়ায় সেই নাবালিকা কিশোরী পরে নাকি আত্মহত্যা করেছিল। হাওড়ার বাঁকড়ায় মা ও ছেলের বিরুদ্ধে এমনই সাংঘাতিক অভিযোগ এনেছেন নাজিরগঞ্জের এক ব্যবসায়ীও।

    প্রশ্ন উঠেছে, অভিযুক্ত আরিয়ান কি শ্বেতার নিজের সন্তান? তা নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে প্রতিবেশীদের মধ্যেই। তবে শ্বেতার স্বামী নাকি বছর আটেক আগে ফুরফুরা শরিফে চলে যান। পরিবারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই বলেই স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে।

    অভিযোগ, কাজ দেওয়ার নাম করে উত্তর ২৪ পরগনার সোদপুরের এক তরুণীকে ডেকে জোর করে তাঁকে দেহ ব্যবসায় নামাতে চান শ্বেতা ও আরিয়ান। প্রতিরোধ করলে ওই তরুণীর উপরে নেমে আসে অকথ্য অত্যাচার। তরুণীর অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ মামলা দায়ের করেছে।

    এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন শ্বেতা ও আরিয়ান। নির্যাতিতা ওই তরুণী রবিবার বলেন, ‘আমি বিচার চাই। অভিযুক্তদের যেন কঠোর সাজা হয়। অন্য মেয়ের সাথে ওরা যাতে আর এরকম করতে না পারে।’

    তদন্তে নেমে ডোমজুড় থানার পুলিশ জানতে পেরেছে, দিনের পর দিন ফ্ল্যাটে আটকে রেখে বহু মেয়েকেই দেহ ব্যবসায় নামতে বাধ্য করেছিলেন হাওড়ার মা-ছেলে জুটি।

    অভিনয়, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থায় কাজের টোপ দিয়ে বিভিন্ন বয়সের মহিলাদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে তাঁদের ফ্ল্যাটে ডেকে আনতেন আরিয়ান। পরে সোদপুরের নির্যাতিতা তরুণীর মতোই তাঁদেরও আটকে রেখে চালানো হতো দেহ ব্যবসা, ব্লু ফিল্ম তৈরি।

    পড়শিদের দাবি, এতদিন মা-ছেলের ভয়ে এলাকায় কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি। যাঁরা আগে প্রতিবাদ করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির মতো মামলা করেছেন শ্বেতা। এলাকায় ‘ফুলটুসি বেগম’ নামে পরিচিত ছিলেন তিনি।

    অভিযোগ, যে ভাড়া ফ্ল্যাটে কুকীর্তি চালাতেন, গত ১৫ বছর ধরে তার ভাড়াও দেননি। দিঘা, দার্জিলিং এমনকী মুম্বইয়েও ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ব্লু ফিল্ম তৈরির অভিযোগ উঠেছে শ্বেতা ও আরিয়ানের বিরুদ্ধে।

    এ দিন বাঁকড়ায় গিয়ে দেখা যায়, যে বাড়ির দোতলায় ওই ফ্ল্যাট, তার চারিদিক সিসিটিভি ক্যামেরায় মোড়া। ফ্ল্যাটে পোষা কুকুরের ভয়ে বাইরের লোক কেউ ঢুকতে পারতেন না। এখন সেই ফ্ল্যাট তালাবন্ধ। কুকুরও নেই।

    ওই বাড়ির মালিক আমিনা বেগম বলেন, ‘১৫ বছর ধরে ফ্ল্যাটের ভাড়া দেয়নি। ওরা বাইরের কেনা জল খেত। কিন্তু সেই জলের টাকাও দিত না। কেউ টাকা চাইতে গেলে তাদের নামে নোংরা কেস দিত। কে ওদের সঙ্গে লাগতে যাবে?’ আমিনার অভিযোগ, মামলার ভয় দেখিয়ে পাড়ায় অনেক বড় বড় লোককেও ঘোল খাইয়ে রেখেছিলেন মা–ছেলে।

    আমিনা জানান, প্রতিদিন সন্ধ্যায় বেরিয়ে যেতেন আরিয়ান ও শ্বেতা। ভোরবেলা গাড়িতে করে ফিরতেন। আরিয়ান মাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে গ্যারাজে গাড়ি রাখতে যেতেন। মনে করা হচ্ছে, সেই গাড়ি ও কুকুর নিয়েই চম্পট দিয়েছেন মা ও ছেলে। শ্বেতার পেশা সম্পর্কেও পাড়ার কেউ বিশেষ কিছু জানতেন না।

    পড়শিদের দাবি, বাংলা ও ওডিশি ছবিতে অভিনয় করেন বলে দাবি করতেন শ্বেতা। ফ্ল্যাটে অল্পবয়সি মহিলাদের আনাগোনা লেগে থাকত বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

    বাইরে থেকে নানা বয়সের অনেক লোকজনও আসতেন। দক্ষিণ ভারতের ছবির অভিনেতা বলে দাবি করা এক ব্যক্তিও মাঝেমধ্যে ওই ফ্ল্যাটে দু–তিন দিন করে থাকতেন বলে জানা গিয়েছে।

    হাওড়ার নাজিরগঞ্জের ব্যবসায়ী মাসুদ আলম খানের থেকে জানা গিয়েছে আরও এক বিস্ফোরক তথ্য। রবিবার তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে ও আরিয়ানের বোন একইসঙ্গে পড়ত। মেয়েটি আত্মহত্যা করে। কারণ ওর মা ও দাদা ওকে খারাপ পথে নামতে বাধ্য করছিল। সেই কথা আমার ছেলেকে বলেছিল ও।’

    তিনি জানান, কোনও চাকরির ফর্ম ভরতে তাঁর ছেলের কাছ থেকে ১৩০০ টাকা ধার নিয়েছিল ওই কিশোরী। তার পরেও মা ও দাদার চাপে আত্মহত্যা করে মেয়েটি। মাসুদের অভিযোগ, ‘মেয়ে আত্মহত্যা করার পরে শ্বেতা আমার কাছ থেকে এক কোটি টাকা চেয়েছিল। বলেছিল টাকা না দিলে আমার ছেলেকে ফাঁসানো হবে।’

    মাসুদ টাকা দেননি। মাসুদের ছেলে–সহ আরও কয়েকজনের নামে নাকি থানায় অভিযোগ জানান শ্বেতা। পরে পুলিশ তদন্তে জানা যায়, ঘটনার সঙ্গে তারা েকউ জড়িত নয়।

    ৬ জুন ওই ফ্ল্যাট থেকে পালিয়ে যান সোদপুরের নির্যাতিতা তরুণী। প্রকাশ্যে আসে ঘটনার কথা। সোদপুরের তরুণী জানিয়েছিলেন, আরিয়ানের দিদিমা তাঁকে পালাতে সাহায্য করেছিলেন।

    আরিয়ানের দিদিমা, শাহনাজ বেগম থাকেন শ্বেতাদের ফ্ল্যাট থেকে প্রায় ১০০ মিটার দূরে অন্য একটি ফ্ল্যাটে। রবিবার বলেন, ‘আমার নাতিকে পুলিশ কেন খুঁজছে জানি না। পুলিশ এসেছিল। আমি তখন বাড়িতে ছিলাম না।’

    তাঁর পাল্টা দাবি, ‘আমাদের রাস্তার ধারে বাড়ি। যদি ওই মেয়েটার উপরে সত্যি অত্যাচার করা হতো, তা হলে তার চেঁচামেচির আওয়াজ কেউ শুনল না কেন?’

    গোটা ঘটনায় প্রশ্নের মুখে জোমজুড় থানার পুলিশ। স্থানীয় বাসিন্দা শাকিবা বেগম বলেন, ‘বাড়িতে বাইরে থেকে লোক এনে নোংরামি চলত। পুলিশ, এলাকার অল্পবয়সি ছেলেদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে রেখেছিল।’

    স্থানীয় যুবক পান্না গাজির কথায়, ‘ফ্ল্যাটে দীর্ঘদিন ধরে র‍্যাকেট চালাত। প্রতিবাদ করেছিলাম বলে আমাদের সাতজনের নামে মিথ্যা কেস দিয়ে ফাঁসিয়েছে। পুলিশ ওকে না ধরে আমাদের ধরল। পাড়ায় এমন কোন লোক নেই, যার নামে ওরা মিথ্যে মামলা দেয়নি। পুলিশ সব জেনেও চোখ বন্ধ করে ছিল।’

    এ দিন বারবার হাওড়ার পুলিশ কমিশনার প্রবীণ ত্রিপাঠীকে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। ডোমজুড় থানা জানিয়েছে, ঘটনার তদন্ত চলছে৷ মা ও ছেলের বিরুদ্ধে নাবালিকা-সহ অন্য মহিলাদের জোর করে আটকে রাখা, অত্যাচার–সহ একাধিক অভিযোগে মামলা শুরু হয়েছে।

    সোদপুরের ওই নির্যাতিতা কামারহাটি সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি। রবিবার তাঁর সিটি স্ক্যান হয়েছে। এ দিন হাসপাতালে গিয়ে নির্যাতিতার সঙ্গে কথা বলে পুলিশ। তরুণীর মামাতো ভাই বলেন, ‘দিদি আগের থেকে একটু ভালো। কথাবার্তা বলছে। চোখ দুটোও অল্প করে খুলতে পারছে।’

    তবে আরিয়ান ও শ্বেতা গ্রেপ্তার না হওয়ায় আতঙ্কে রয়েছেন তরুণী বাবা-মা। আতঙ্কে তাঁরা কাজে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। গোটা ঘটনাটি নিয়ে খোঁজ শুরু করেছে জাতীয় মহিলা কমিশনও।

  • Link to this news (এই সময়)