কেউ দিনমজুরের কাজ করছেন, কেউ করছেন বরফ কলে কাজ। কেউ বা চাষির থেকে আনাজ কিনে হাটে বিক্রি করছেন। চাকরিহারা গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি কর্মীরা জানাচ্ছেন, তাঁদের অবস্থাই এখন সব থেকে খারাপ। গত দু’মাস ধরে বেতন নেই। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা করা ভাতা এখনও পর্যন্ত মেলেনি। মামলার ধাক্কায় সেই ভাতাও কার্যত অনিশ্চিত বলে অনেকে মনে করছেন। দু’মাস বেতন না হওয়ায় ওই শিক্ষাকর্মীদের অনেকেরই প্রশ্ন, তা হলে কী ভাবে পরিবার প্রতিপালন করবেন? ইএমআই দিতে না পেরে কেউ কেউ ভাবছেন, নিজের বসতবাড়ি নিলামে তুলে দেবেন। ওই সব শিক্ষাকর্মীর দাবি, শিক্ষা দফতর তাঁদের প্রতিই সব থেকে বেশি উদাসীন। তাঁদের অভিযোগ, কেন শিক্ষকদের মতোই শিক্ষাকর্মীদের মধ্যে যোগ্য-অযোগ্য বিভাজন করা হচ্ছে না?
বাঁকুড়ার ওন্দা ব্লকের একটি স্কুলে গ্রুপ সি কর্মী ছিলেন আশিস মণ্ডল। তিনি এখন দিন প্রতি ৩০০ টাকার বিনিময়ে দিনমজুরের কাজ করেন। আশিস বলেন, “কী করব, এ ছাড়া তো কিছু উপায় নেই।” বাড়িতে দুই ছেলে, এক জনের বয়স দেড় আর এক জনের বয়স চার বছর। বৃদ্ধ মা, বাবা রয়েছেন। আশিস বলছেন, “সরকার আমাদের জ্বলন্ত চিতার দিকে ঠেলে দিল। কিন্তু চিতায় ঠেলে দিলেও চিতায় উঠে তো যেতে পারি না। পরিবারের এতগুলো মানুষ আমার উপরে নির্ভরশীল। তাই দিনমজুরের কাজ করছি।” আশিস বলেন, “চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষকদের জন্য তাও একটা ব্যবস্থা করেছে শিক্ষা দফতর। কেন, আমাদের মধ্যে যোগ্য-অযোগ্য ভাগ হবে না?”
মুর্শিদাবাদ জেলার একটি স্কুলের গ্রুপ সি কর্মী প্রশান্ত সরকার আবার বাড়ির কাছে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে কর্মচারী হিসেবে রয়েছেন। প্রশান্তের এক ছেলে, এক মেয়ে। তিনি বলেন, “হার্ডওয়্যারের দোকান আমাকে মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতনে রেখেছে। তাতেই রাজি হয়েছি! কারণ এ ছাড়া আমার অন্য কোনও উপায় নেই। ঋণ নিয়ে বাড়ি তৈরি করেছিলাম। সেই ইএমআই-এর কিস্তি মেটাতে পারছি না। সেই বাড়ি এ বার নিলামে বিক্রি করে দিতে হতে পারে।” প্রশান্ত জানান, তিনি যে স্কুলে কাজ করতেন সেখানে গ্রুপ ডি কর্মী ছিল না। তাই তাঁকে গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি— দু’রকম কাজই করতে হত। চাকরিহারা হওয়ার পরে স্কুল থেকে তাঁকে আবার ডেকেছিল। বলেছিল যে, তিন-চার হাজার টাকায় কাজটা করে দিতে। প্রশান্ত বলেন, “ এই চার হাজার টাকায় আর আমার কী-ই বা হত। তাই বাধ্য হয়ে অন্য কাজ করছি।” প্রশান্তের প্রশ্ন “কেন শিক্ষকদের মতো আমাদের মধ্যেও যোগ্য-অযোগ্য ভাগ করা হচ্ছে না? আমাদের মধ্যে যাঁরা যোগ্য, তাঁদের প্রতি তো অবিচার করা হচ্ছে।”
মুর্শিদাবাদের গ্রুপ সি কর্মী চিন্ময় হালদার বাড়ির কাছে একটি বরফ কলে কাজ করেন। কারখানা থেকে বরফ তুলে তা বিক্রির কাজ করতে হয়। এই কাজের জন্য প্রতিদিন তিনি ২৫০ টাকা করে পান। চিন্ময় বলেন, “বাড়িতে স্ত্রী, ছেলে আর মেয়ে আছে। বৃদ্ধ মা অসুস্থ। এক দিনও বাড়ি বসে থাকলে আমার চলবে না। তাই হাতের সামনে যা কাজ পাচ্ছি, তা-ই করছি।”
গ্রুপ সি কর্মী পূরবী মণ্ডল কাজ হারিয়ে এখন পুজোর সময়ে হাতে যে সুতো বাঁধা হয়, সেই সুতো বাঁধার কাজ করেন। বনগাঁর বাসিন্দা পূরবী বলেন, “পাইকারি বাজার থেকে পুজোর সুতো কিনে ছোটছোট টুকরো করে বেঁধে রাখি। বিভিন্ন পুজোয় হাতে বাঁধার জন্য সুতোগুলো বিক্রি হয়। মাসে দু’-তিন হাজার টাকার বেশি হয় না। স্বামী একটি বেসরকারি সংস্থায় ছোটখাটো কাজ করে, বাড়িতে অসুস্থ মা রয়েছেন। এর পরে ভাবছি কাগজের থালা তৈরির কাজ করব। কিন্তু তার জন্য আবার পুঁজি লাগবে! জানি না, সেই পুঁজি কোথায় পাব।” পূরবীর মতে, সরকার তাঁদের খাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। শিক্ষকদের মতো তাঁরা যদি ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেতেন, তা হলেও কিছুটা অন্তত সংসার বাঁচত। পূরবী বলেন, “আমাদের কথা তো সরকারের আগে ভাবা উচিত! কারণ আমাদের বেতন সব থেকে কম।"
পশ্চিম মেদিনীপুরের গ্রুপ ডি কর্মী বিবেকানন্দ ঘটক চাষিদের কাছ থেকে আনাজ কিনে হাটে বিক্রি করছেন। বিবেকানন্দ জানান, তাঁকে এখন রোজ ভোর সাড়ে ৩টে, ৪টেয় উঠতে হয়। তার পরে টোটো করে চাষিদের কাছ থেকে আনাজ কিনে তা হাটে বিক্রি করেন। বিবেকানন্দের কথায়, “এত খাটাখাটনি করছি, কারণ না-হলে সংসারটা ভেসে যাবে। ভবিষ্যৎ কী, জানি না। তবে আমরা নতুন করে পরীক্ষা দিতে পারব না। এক বার যে যোগ্যতা অর্জন করেছি, তা কেন বার বার দেব? আমাদের তো দোষ নেই। এটা প্রাতিষ্ঠানিক দূর্নীতি হয়েছে।”
গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি-দের জন্য কোনও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বার হবে কি না, তা নিয়ে অবশ্য বিকাশ ভবনের কর্তারা মুখ খোলেননি। তাঁরা শুধু জানিয়েছেন, গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি-র বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মতোই তাঁরা কাজ করেছেন।