মানুষের তৈরি কৃত্রিম আলোর দাপটে নিজেদের মধ্যে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে যোগাযোগ, দিশাহারা জোনাকি পোকা
আনন্দবাজার | ০৯ জুন ২০২৫
জোনাকির আলো নিয়ে সঙ্গীত-সাহিত্যে কম রসদ নেই। খোদ রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘‘স্বপ্ন আমার জোনাকি দীপ্ত প্রাণের মণিকা..।’’ কবিতার শব্দের মধ্যে দপদপে আলো জ্বলা এই পোকাদের খুঁজে পেয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ। কিন্তু বাস্তবে এ বার সেই জোনাকিরাই পড়েছে আলোর বিপদে! মানুষের তৈরি কৃত্রিম আলোর দাপটে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলছে জোনাকিরা। বিপন্ন হচ্ছে জীবন।
দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বাঙালি বিজ্ঞানী সৃঞ্জনা ঘোষের গবেষণায় উঠে এসেছে সেই তত্ত্ব। তিনি জানাচ্ছেন, রাতের বেলা যে ভাবে আলো বাড়ছে, তা জোনাকিদের জীবনে কুপ্রভাব ফেলছে। ক্ষতিহচ্ছে নিশাচর এই পোকাদের। এই সংক্রান্ত গবেষণা ‘জার্নাল অব ট্রপিকাল ইনসেক্ট সায়েন্স’-এ প্রকাশিত হয়েছে।
এই পোকাদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এ রাজ্য থেকেই জোনাকির দু’টি নতুন প্রজাতিও আবিষ্কার করেছেন সৃঞ্জনা। তাদের একটি পাওয়া গিয়েছে সুন্দরবন থেকে এবং অন্যটি খাস কলকাতা থেকেই। সেই আবিষ্কার সংক্রান্ত গবেষণাপত্র ‘ওরিয়েন্টাল ইনসেক্টস’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তথা প্রাণিবিজ্ঞানী সুশান্তকুমার চক্রবর্তীর অধীনে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন বেথুন কলেজের প্রাণিবিদ্যার শিক্ষিকা সৃঞ্জনা। তিনি জানান, সুন্দরবন থেকে আবিষ্কৃত জোনাকির বিজ্ঞানসম্মত নাম দেওয়া হয়েছে ট্রায়াঙ্গুলারা সুন্দরবনেনসিস এবং কলকাতা থেকে প্রাপ্ত প্রজাতির বিজ্ঞানসম্মত নাম দেওয়া হয়েছে মেডিয়োপটেরিক্স বেঙ্গালেনসিস। এগুলি জোনাকি জগতে ‘লুসিয়োলিনাই’ গোত্রভুক্ত।
এই দুই প্রজাতির আবিষ্কার তাৎপর্যপূর্ণ হলেও অনেকেই মনে করছেন, কৃত্রিম আলোর দাপটে জোনাকিদের বিপন্ন হয়ে পড়া পরিবেশগত ভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কী ভাবে আলোর দাপটে বিপাকে পড়ছে জোনাকিরা?
সৃঞ্জনা জানান, লুসিয়োলিনাই গোত্রের জোনাকিদেরই এই অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। এরা সাধারণত সন্ধ্যার পর থেকে সক্রিয় হয়। জোনাকির শরীরে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে আলো তৈরি হয় এবং অন্ধকারে এই আলোই যুগে-যুগে মানুষকে বিস্মিত করেছে। শরীরের এই আলো দিয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে জোনাকি পোকারা। বিশেষকরে প্রজনন কালে এই ঝিকমিক করা আলো দেখেই নারী জোনাকির প্রতি আকৃষ্ট হয় পুরুষ পোকা। কিন্তু রাতের বেলা কৃত্রিম আলোর দাপটে সেই সঙ্কেতই বুঝতে পারছে না তারা। তার ফলে প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে।শুধু প্রজনন নয়, আলো পরোক্ষ ভাবে প্রভাব ফেলছে জোনাকিদের লার্ভার বেঁচে থাকার উপরে। এই বাঙালি প্রাণীবিজ্ঞানীর মতে,কৃত্রিম আলোর প্রভাব শামুক-সহ বিভিন্ন সন্ধিপদী এবং অমেরুদণ্ডী প্রাণীর উপরেও পড়ছে। তাদের বসবাসের এলাকা বদলে যাচ্ছে। অথচ জোনাকির লার্ভারা এই প্রাণীগুলি খেয়ে বেঁচে থাকে। তাই পরোক্ষ ভাবে খাবারও কমছে জোনাকিদের লার্ভাদের।
জোনাকি পোকার উপরে কৃত্রিম আলোর এই প্রভাবকে ‘অশনি সঙ্কেত’ হিসেবে দেখছেন পরিবেশবিজ্ঞানীদের অনেকে। তাঁরা বলছেন, বাস্তুতন্ত্রেসব ধরনের প্রাণী এবং উদ্ভিদের ভূমিকা আছে। এর মধ্যে কোনওএকটি প্রজাতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা বাকিদের উপরেও কুপ্রভাব ফেলে। তাই আলোর দূষণে জোনাকি পোকারা ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরিবেশের সামগ্রিক ক্ষতি হবে। প্রসঙ্গত, জাপানে এই বিপদ আগেই টের পাওয়া গিয়েছে এবং জাপানিদের প্রিয় জোনাকির সংরক্ষণও শুরু হয়েছে। এ দেশেও তেমন হবে কি?